• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা

প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা জ্ঞান অর্জন করি বা করার বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করি

সংগৃহীত ছবি

মতামত

শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ৩১ অক্টোবর ২০১৮

মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য স্বশাসন বা স্বনিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীনতা ভোগ করার জন্য। শিশুকে খাওয়ানোর সময় দেখা যায়, সে হাত দিয়ে চামচ ধরতে চায় এবং নিজে খেতে চায়; একটু বড় হলে হাঁটার জন্য নিজে সামনে পা বাড়ায়; আরো বড় হলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য কাজ খোঁজে। এগুলো সবই স্বাধীনতা লাভের চেষ্টা। আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি, শিশু তার জন্মগত স্বাধীনতার এই প্রবৃত্তি স্কুলে অনুসরণ করতে পারছে কি-না? শিশু শিক্ষার্থীরা সবসময়ই খুব বেশি উত্তেজিত থাকে এবং বিমোহিত হয় নতুন কিছু জানার এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। কিন্তু তাদের নিয়মানুবর্তী করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বিদ্যালয়ে যা করানো হয় তা তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং শিক্ষার্থী তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়।

প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা জ্ঞান অর্জন করি বা করার বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করি। ক্রিটিক্যাল পেডাগজি বলছে, শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছেও শেখে, শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে। অতএব, পেডাগজি শুধু শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হবে না, হবে শিক্ষাকেন্দ্রিক। শিখন পরিবেশ সৃষ্টিশীল হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আদান-প্রদানের মাধ্যমে। এভাবে বলা যায়, কেউই পূর্ণ শিক্ষিত নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী পূর্বঅভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস অনুযায়ী শিখতে পারে এবং জীবনের বাস্তবতার জন্য নতুন পথের সন্ধান পেতে পারে। শিক্ষার স্বাধীনতা ক্রিটিক্যাল পেডাগজির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীকে যদি জ্ঞানের উৎস ধরা হয়, তা হলে তাকে স্বাধীন হতে হবে এবং তখনই সে নিজের অভিজ্ঞতাগুলোকে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে আসবে।

শিক্ষকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে শিক্ষার্থীর শিক্ষার দায়িত্ব নিজেরা গ্রহণ করবে এবং জ্ঞানলাভের অন্যান্য উৎসের ওপরও নির্ভরশীল হবে। যেসব শিক্ষার্থী প্রকৃতিগতভাবেই মোটিভেটেড এবং মেধাবী, তারাই ক্লাসের বাইরে অধিকাংশ কার্যাবলি গ্রহণ করতে রাজি হয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থী, যারা নিজেরা কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো কাজ করবে না, তারা তাহলে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করবে? নাকি তারা পুরোটাই শিক্ষকদের এবং প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকবে?

বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাধারণভাবে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যক। শিক্ষার্থীর সামাজিক এবং আবেগীয় উন্নয়নের জন্য পড়ার ভূমিকা অনেক। শিক্ষার্থীরা যদি বিভিন্ন ধরনের পড়ার বিষয় বা ম্যাটেরিয়ালস না পড়ে, তাহলে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দক্ষতা হারাবে। পড়ার মাধ্যমে তারা তাদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে পারে। বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ, যেমন— গণিত, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং ভূগোল সম্পর্কে জানার দ্বার উন্মোচন করে। এভাবে পড়ুয়ারা এসব বিষয়ে সহজেই সাফল্য অর্জন করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট সময় থেকেই পড়ার অভ্যাস মানুষকে অনেক বেশি পজিটিভ বিষয় দান করে, তাই ছোট সময় থেকেই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, আর এ বিষয়টি খেয়াল রাখবেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা।

একজন শিক্ষক যত ভালোই হোক, শিক্ষার্থীরা কখনোই ভাষা শিখবে না কিংবা অন্য কোনো বিষয় শিখবে না, যদি না শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে শেখার প্রস্তুতি না নেয়। এর কারণ হচ্ছে, ভাষা শেখা কিংবা শিক্ষার্থীর অপরিচিত নতুন কিছু শেখা একটি জটিল কাজ এবং বিভিন্নমাত্রিক। এজন্য শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের কিংবা শিক্ষকের পুরো নিয়ন্ত্রণে থাকলে হবে না, শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে শেখার সময় ও সুযোগ দিতে হবে। ডেভিড নুন্যান বলেছেন, ‘ক্লাসে সবকিছু শেখানো যায় না। যদি যায়ও, তারপরেও বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার যে, একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর পাশে থাকেন না যখন শিক্ষার্থী বাস্তব জীবনে ভাষা ব্যবহার করে।’ এর অর্থ হচ্ছে, শিক্ষার্থী ভাষা এবং তার অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করে, সেখানে শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ক্লাসের কম সময় পুষিয়ে নেওয়ার জন্য এবং নিষ্ক্রিয়তা যা সত্যিকার শেখার ক্ষেত্রে শত্রু তা প্রতিরোধ করার জন্য শিক্ষার্থীর নিজের ভাষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যতটা সম্ভব স্বাধীন শিক্ষার্থী হতে হবে। তবে সবসময় একাকী/নিজ থেকে এ ব্যাপারটি হয়ে ওঠে না। শিক্ষা-সংস্কৃতির দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রিত হয় যে, সংস্কৃতিতে শিক্ষার্থী ভাষা শেখে।

একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ক্লাসে স্বাধীনতা দিতে পারেন প্রতিফলনের মাধ্যমে। শিক্ষার্থীরা কী শিখেছে, তার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য শিক্ষক একধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন, যেন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা নিজের স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারে। রিফ্লেকশন শিক্ষার্থীর ভালো ও দুর্বল দিকগুলো নিয়ে চিন্তা করতে সহায়তা করে। ভাষা শেখার ক্ষেত্রে স্পিকিং বা লিসেনিং কঠিন কেন? এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহ পরে বিশেষ কোনো লেসনের ওপর শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারে।

ক্লাসের বাইরে বাসার কাজই শিক্ষার্থীর নিজের স্বাধীনতা প্রয়োগ করার শক্তিশালী পথ। এখানে শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া শিক্ষার্থী কাজ করে। তবে শিক্ষককে নির্দিষ্ট করে দিতে হয় কতটুকু হোমওয়ার্ক শিক্ষার্থী বাসায় করবে। শিক্ষককে খেয়াল রাখতে হবে একজন শিক্ষার্থীকে শুধু একটি বিষয় অধ্যয়ন করতে হয় না, সেখানে রয়েছে একাধিক বিষয়। হোমওয়ার্কের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে গিয়ে যেন তা বোঝা না হয়, তাহলে তারা ক্লাসে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তবে হোমওয়ার্ক যদি প্রাসঙ্গিক হয়, তাহলে তা শিক্ষার্থীরা কিছুটা আনন্দ নিয়ে করবে। এমনকি নিজ স্বাধীনতার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে তা করবে। অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ডায়েরি বা জার্নাল লিখতে বলেন, যাতে শিক্ষার্থীরা রিফ্লেক্ট করতে পারে তাদের সাফল্য, কঠিনত্ব, তাদের পছন্দ ও অপছন্দের বিষয়। এখানে শিক্ষার্থী যা শিখেছে সে সম্পর্কে লিখতে পারে। আবার সম্পূর্ণ নতুন বিষয়ও লিখতে পারে। শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরি ক্লাসে এক ধরনের অটোনমি ভোগ করে। সেখানে নিজেদের ইচ্ছামতো বই উল্টাতে পারে, নিজের ইচ্ছেমতো পড়তে পারে, পছন্দের বইটি নিতে পারে শেলফ থেকে। এভাবে পুরো লার্নিং প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুই স্বাধীনভাবে শেখে।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

 

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads