• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বাঙালিকে নেতৃত্ব ও মেধাশূন্য করতেই জেল হত্যাকাণ্ড

জাতীয় চার নেতা

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

বাঙালিকে নেতৃত্ব ও মেধাশূন্য করতেই জেল হত্যাকাণ্ড

  • এ এইচ এম ফিরোজ আলী
  • প্রকাশিত ০৩ নভেম্বর ২০১৮

আজ ৩ নভেম্বর শোকাবহ ও বেদনাবিধুর ৪৪তম জেলহত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ২ মাস ২০ দিন পর ৩ নভেম্বর মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য ও কলঙ্কময় রক্তঝরা এই দিন। ওইদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে চার জাতীয় নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল বিশ্ববিবেক। কারাগারে থাকাবস্থায় বর্বরোচিত এমন খুনের ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

হত্যাকাণ্ডের পরদিন ডিআইজি প্রিজন কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেন। ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. মতিউর রহমান রায় ঘোষণা করে ২০ আসামির মধ্যে ১২ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন, রিসালদার মোসলেউদ্দিন ওরফে হিরন খান, দফাদার মারফত আলী শাহ্, এলডি দফাদার মো. আবদুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম মনজু, মেজর (অব.) খায়রুজ্জামানকে খালাস প্রদান করেন।

মুজিবনগর সরকার গঠন করে মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন করা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সরকারে যোগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করায় তাদের হত্যার মূল কারণ বলে ইতিহাসে সাক্ষ্য রয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড ছিল জাতির পিতাকে হত্যার ধারাবাহিকতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস, বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব ও মেধাশূন্য করা ছিল জেল হত্যাকাণ্ডের অন্যতম লক্ষ্য। একই উদ্দেশ্যে ’৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, যারা এ ভূখণ্ডকে স্বাধীন করতে চেষ্টা করেছেন, জাতির সেসব শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করে পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করা হয়।

৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঘাতক মোসলেউদ্দিনকে ঢুকতে দেওয়ার আগে ডিআইজি প্রিজন টেলিফোনে রাষ্ট্রপতি মোশতাকের অনুমতি নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের ঘটনাবহুল রাজনীতির বিরল সাক্ষী লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার এক বইয়ে এসব তুলে ধরেছেন। ভোর ৪টায় খন্দকার মোশতাক কর্নেল রশিদসহ কয়েকজনকে জেলের ভেতর ঢোকার সম্মতি দেন। ফারুক-রশিদ পরিকল্পিত পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য রিসালদার মোসলেউদ্দিন তার দলবল নিয়ে কারাগারে প্রবেশ করেন। কারাগারের একটি কক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অপর সেলে ছিলেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। তাদের দুজনকে তাজউদ্দীন আহমদের সেলে এনে খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে নৃশংসভাবে খুন করা হয় বঙ্গবন্ধুর স্নেহের জাতীয় চার নেতাকে। তিনজন সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারালেও তাজউদ্দীন আহমদ পেটে ও পায়ে গুলি লাগায় রক্তক্ষরণের ফলে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে মারা যান। বর্বর ঘাতক মোসলেউদ্দিন ও তার গ্যাং চলে যাওয়ার আগে সেলটিকে খুব শক্ত করে তালাবদ্ধ করে রেখে যায়। ফলে মৃত্যুর আগে তাজউদ্দীনের মুখে কেউ এক ফোঁটা পানিও দিতে পারেননি।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামারুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা, তাজউদ্দীন আহমদ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ও কামারুজ্জামান সচিব নির্বাচিত হন। আর প্রাদেশিক পরিষদ নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। ’৬৪-তে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ’৬৬-তে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা শেষে সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম সহ-সভাপতি, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অন্যতম সহ-সভাপতি এবং কামারুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৬৮-তে কারাবন্দি থাকাবস্থায় সাধারণ সম্পাদক পুনর্নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। ছাত্র থাকাকালীন সুদক্ষ নেতৃত্বের বিস্ময়কর প্রতিফলন ঘটে সৈয়দ নজরুল ইসলামের চরিত্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকাকালে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে হল সংসদ নির্বাচনে ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭-৪৮ সালে সলিমুল্লাহ হলের সহ-সভাপতি ও কিছুদিন পর মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ’৭২ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পেয়ে ’৬৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ’৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর একজন অন্যতম আইনজীবী ছিলেন। ২৫ মার্চ ’৭১ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ’৭২ সালে সংসদের উপনেতা নির্বাচিত হন।

’৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন ও ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন জাতীয় এই চার নেতা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সঙ্গে সুচিন্তিত মতবিনিময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের চিন্তার মাধ্যমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরকার পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে থাকেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলে আপামর জনতা মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয় এবং ধীরে ধীরে সূচিত হতে থাকে বিজয়ের ধারা। এ সরকারের দূরদর্শী কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করা সম্ভব হয়। অক্টোবরে ভারত সফররত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের উপস্থিতিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দাবি করেন। ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। পরেরদিন ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অংশ নেয় এবং ৭ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে। এ সময় যশোরে ছুটে আসেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতার অবদান শুধু উল্লেখযোগ্য নয়, চিরস্মরণীয়ও বটে। তাদের অবদান ও বীরত্বগাথা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। বাঙালি জাতির জন্য জাতীয় চার নেতার মৃত্যু ছিল অপূরণীয়।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads