• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাফল্যের মেরুদণ্ড

  • সৈয়দ আবুল হোসেন
  • প্রকাশিত ০৫ নভেম্বর ২০১৮

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম, যদিও আয়তনের হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৯৮তম। মাত্র ৫৫,৯৭৭ বর্গমাইল আয়তনের এ দেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৫.৫৯ কোটির বেশি। জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা এবং শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ১১,৯৮,৯২৩ কোটি টাকা (চলতি বাজার মূল্যে), যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বৃদ্ধি লাভ করে ১৩,৫০,৯২০ টাকায় উন্নীত হয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের মাথাপিছু বার্ষিক আয় পূর্ববর্তী বছরের ১,০৪৪ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১,১৯০ ডলারে উন্নীত হয়েছে মর্মে সরকারি বিবরণে প্রকাশিত হয়। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৯২,৫১০ টাকা। ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে যা ১,৪৬৬ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২৬.২০ শতাংশ, অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১১.৯০ শতাংশ, এবং বার্ষিক দারিদ্র্য হ্রাসের হার ১.৫ শতাংশ। এই উন্নয়নশীল দেশটি দুই দশক যাবৎ বার্ষিক ৫ থেকে ৬.২ শতাংশ হারে আর্থিক প্রবৃদ্ধি অর্জনপূর্বক ‘পরবর্তী একাদশ’ অর্থনীতির দেশসমূহের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে কাজ করেছে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত শ্রেণির দ্রুত বিকাশ এবং একটি সক্ষম ও সক্রিয় উদ্যোক্তা শ্রেণির নিরলস শ্রম। বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সারাবিশ্বে প্রসিদ্ধ। জনশক্তি রফতানিও দেশটির অন্যতম অর্থনৈতিক হাতিয়ার।

বাংলাদেশ জনভারে ন্যুব্জ কোনো পরমুখাপেক্ষী দেশ নয়। বাংলাদেশ আজ ১৬ কোটি কর্মীবাহিনীর ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে বলীয়ান একটি উদ্ভাসিত জাতি, যার শিকড় পাতালের গভীরে আর মস্তক আকাশের চূড়ায়। আমরা এখন আমাদের নিয়ে একাই এগিয়ে যেতে পারি। পদ্মা সেতু প্রকল্পের মতো বিশাল প্রকল্প নির্মাণেও আমাদের কারো মুখাপেক্ষী থাকতে হয় না। এটি আমাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি, স্বপ্নমুখর জাতির সামগ্রিক ইচ্ছা আর ঐকান্তিক চেষ্টার প্রতিফলন।

এ একটি পতাকা ও বিজয়ের হাসি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শক্তি- আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য। সবার পরিচয়ের ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ‘স্পিরিট’। একই উদ্দেশ্য এবং স্বদেশপ্রেম- আমাদের শক্তি, উৎসাহ ও উদ্যম দেয়। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও সাহসী করে তোলে। জার্মান কবি, দার্শনিক, ইতিহাসবেত্তা ও নাট্যকার জোহান ক্রিস্টোফ ফ্রেডরিক ভন শিলার (Johann Christoph Friedrich Von Schiller)-এর ভাষায় বলা যায় : Even the weak become strong when they are united. আমরা আজ ঐক্যবদ্ধ, আমাদের শক্তি এখন তাই অজেয়।

সমসাময়িক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে জোটভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছোট হলেও বিভিন্ন দিক থেকেই সবচেয়ে বেশি সফল ও সার্থক। জাতি হিসেবে আমাদের সফলতা ইতিহাসের এ গুরুত্বপূর্ণ পাঠ শিক্ষা দেয় যে, কেউ ইচ্ছা ও পণ করলেই নিজেদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে এবং পৌঁছে যেতে পারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আর জাতিকে নিয়ে যেতে পারে বিশ্বমানের অঙ্গনে।

কোনো জোটই উন্নতিলাভ করতে পারবে না, যদি কেবল তা বস্তুগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে গঠিত হয়। আমরা কোনো সংঘবদ্ধ কোম্পানি নই, বরং আমরা সংঘবদ্ধ মানবসমাজ। আমরা একটি জাতি, যার আছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এবং অবিনাশী লক্ষ্যে ভরপুর উজ্জ্বল সম্ভাবনা আর স্বপ্নিল ভবিষ্যৎ। আমাদের লক্ষ্য অযুত, রথ নিযুত; সে নিযুত রথে চড়ে আমরা জয় করে নিতে পারি অযুত পথের দিশা। তাই কেউ আমাদের ঠেকাতে পারবে না, কোনো দিক দিয়ে, কোনোভাবে। আমরা জানি ঐক্যের সখ্যে কীভাবে নিজেকে গঠন করে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য ছিনিয়ে আনতে হয়।

জোটের জনগণকে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসতে চাইলে অবশ্যই স্বদেশপ্রেম থাকতে হবে। সবার একই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য, অবশ্যই দলীয় শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে। জোটের এবং জোটের জনগণের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। আস্থা শক্তির প্রতীক। বিশ্বাস আর কর্মের মাধ্যমে আস্থা পরস্পরকে নিবিড় শক্তিতে রূপান্তরিত করে। জোটের বন্ধন আস্থার মাধ্যমে শক্তিশালী হয়। পরস্পর সহানুভূতি আর ব্যক্তিগত স্বার্থের পরিবর্তে সামষ্টিক স্বার্থকে গুরুত্ব দিলে আস্থা ইস্পাত-কঠিন ঐক্যে পরিণত হয়।

প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও একাগ্র লক্ষ্যের সমন্বয়ে এই দেশের জনগণ অভিন্ন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তার গভীর স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েছে, যা ক্রমাগতভাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একসঙ্গে তাদের পরিচালিত হতে সহায়তা করেছে। আমরা মানুষ প্রায় ১৬ কোটি, কিন্তু আমাদের চিন্তা একসূত্রে গ্রথিত, আমাদের বিশ্বাস ঐক্যের অভিন্ন রজ্জুতে সমর্পিত। তাই আমরা প্রায় ১৬ কোটি হয়েও এক : One country, one constitution, one destiny and this is our country, Bangladesh.

শর্তাবলির মধ্যেই রয়েছে এর প্রতীকীবাদ। আমি মনে করি, জোটবদ্ধ শক্তিতে চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কাজ করে। প্রথমত, আমাদের মাটি, দ্বিতীয়ত, আমাদের কর্মীবাহিনী, তৃতীয়ত, পতাকা এবং চতুর্থত, আমাদের সরকার। অন্য কথায়, কর্মীবাহিনী কেবল দেশকে ভালোবেসে কাজ করবে, একটি পতাকার নিচে এবং এক নেতৃত্বের অধীনে। যে নেতৃত্ব নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকবে জনকল্যাণে এবং দেশের ও বিশ্বের উন্নয়নে সবসময় সজাগ থাকবে।

আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক জোটেও বাংলাদেশ সক্রিয়। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার-ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা ও বিমসটেকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব শুল্ক সংস্থা, কমনওয়েলথ অব নেশনস, উন্নয়নশীল ৮টি দেশ, জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন, ওআইসি ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থার সক্রিয় সদস্য।

দেশের নেতা, কোম্পানির প্রধান, দলপতি বা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে নেতাসহ সবার প্রতি আমার আহ্বান, চলুন, আগে মানুষের হূদয়গুলোকে ঐক্যবদ্ধ করি, তারপর তাদের প্রচেষ্টাসমূহ। আগে শক্তিকে উপলব্ধি করি, তারপর ক্ষেত্রনির্মাণ। তাহলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই দেশ ও জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ আসনে উপনীত হওয়ার গতি আরো দ্রুত হবে, আরো নিবিড় হবে, আমরা দ্রুত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হব।

লেখক : সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads