• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

চলমান সংলাপ, জনগণের প্রত্যাশা

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০৭ নভেম্বর ২০১৮

অবশেষে সংলাপ হলো। প্রথমে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, তারপর বিকল্পধারা ও যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আওয়ামী লীগের। তারপর হয়েছে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ। আলাপ-আলোচনা-সংলাপ এ শব্দগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায়ই আলোচিত হয়। বিশেষ করে ভোট নিকটবর্তী হলে এ আলোচনা তুঙ্গে ওঠে। অধিকাংশ সময়েই ইতিবাচক ফল হয় না। ২০০৭ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সংলাপ যদি ফলপ্রসূ হতো তাহলে হয়ত এক-এগারোর আধা সেনাশাসিত সরকার এদেশে আসত না। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলেও একাধিকবার সংলাপ হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি। নিকট অতীতে সংলাপের জন্য শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার ফোনালাপের কথাও আমরা জানি। কাজেই সংলাপ শুনলেই জনগণ এখন আর উত্তেজিত হয়ে ওঠে না। কারণ আমাদের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনমনীয় মনোভাব দেখতে দেখতে জনগণ এখন সংলাপ হবে কি না- তা নিয়েই সংশয়ে থাকে।

তবে এবার একটু ভিন্ন ঘটনা ঘটল। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হলো ঐক্যফ্রন্ট আর তাতে যোগ দিলো বিএনপি। খালেদা জিয়া কারাবন্দি, তারেক জিয়া বিদেশে। একের পর এক বাড়ছে খালেদা জিয়ার সাজার মেয়াদ। তারেক জিয়াও দণ্ডপ্রাপ্ত। এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা অনেকটাই দূরপরাহত। বিএনপির নেতাদের নামে একাধিক মামলা। এ অবস্থায় বিএনপির অবস্থা অনেকটা বাদামছাড়া নৌকার মতো।

ফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই মুখর হয়ে উঠল সরকারি দল। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বললেন, ঐক্যফ্রন্টের গোড়াতেই গলদ। তারা জনগণের কাছে না গিয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়েছে। কারণ দশ বছর চেষ্টা করেও তারা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কামাল হোসেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে তিনি মন্ত্রীও ছিলেন। পাকিস্তানের জেলে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই ফ্লাইটে তিনি দেশে ফিরেছিলেন। কিন্তু এদেশের কিছু মানুষ তাকে রাজাকার বানাতেও পিছপা হয়নি। ঐক্যফ্রন্ট প্রথম দিকে সভা-সমিতি করতে বাধার সম্মুখীন হয়। চট্টগ্রামে তারা নির্বিঘ্নে সভা করে। তবে সভায় যাওয়া-আসার পথে বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেফতার হন। আর এই ঐক্যফ্রন্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বরাবর সংলাপের জন্য চিঠি দিলো। চিঠির ভাষা ছিল অত্যন্ত মার্জিত। চিঠিতে তারা বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করলেন।

কিছু দিন ধরে বিএনপি সাত দফা দাবির কথা বলে আসছিল। তখন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, কোনো দাবিই মানা হবে না। তারা সংবিধানের বাইরে যেতে পারবেন না। কিন্তু সাত দফা দাবির সবই যে সংবিধাননির্ভর ছিল এমনো নয়। ঐক্যফ্রন্টের আলোচনাতেও সেই সাতটি দফা অন্তর্ভুক্ত আছে। ক’দিন আগেও আওয়ামী লীগ বলেছিল, ঐক্যফ্রন্ট এসেছে নির্বাচন বানচাল করতে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে। আর যতটা বলেছিল আওয়ামী লীগ তার চেয়ে বেশি ১৪ দল। এ কথা তো ঠিক, ১৪ দলে এমন কিছু নেতা রয়েছেন যাদের ভোট নেই। আওয়ামী লীগের পিছু ধরেই তারা নির্বাচনে জেতেন, মন্ত্রীও হন।

কিন্তু লক্ষণীয়, এবার চিঠি পাওয়ামাত্র ত্বরিত সাড়া দিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী পিতার সহকর্মী ড. কামাল হোসেনের প্রতি যথেষ্ট সৌজন্য প্রদর্শন করলেন। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন, তারা সংবিধানের ভেতরে থেকে সংলাপ করবেন। আর কামাল হোসেন বললেন, সংবিধান বদলানো এক মিনিটের ব্যাপার। বড় কথা, আওয়ামী লীগ সাড়া দিল। আর তারই ধারাবাহিকতায় অনুষ্ঠিত হলো সেই প্রত্যাশিত সংলাপ।

সংলাপ শেষে বেরিয়ে এসে ফখরুল ইসলাম বললেন, সংলাপে তারা খুশি নন। কামাল হোসেন ততটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না দেখালেও বললেন, সব শুনে প্রধানমন্ত্রী একটা বড়সড় বক্তৃতা দিলেন। কিন্তু সভা-সমিতি ছাড়া আর কোনো ব্যাপারেই তেমন আশ্বাস পাওয়া গেল না। তবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বেরিয়ে আসবে। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আর আওয়ামী লীগ বলছে, সংলাপ হয়েছে খোলামেলা পরিবেশে। চাইলে আবারো আলোচনায় আসতে পারে ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্ট ইতোমধ্যে ৬ নভেম্বর তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আর ৭ নভেম্বর আবারো সংলাপে বসছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে।

এ সংলাপ থেকে কী অর্জন হলো বিএনপির? খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের ব্যাপার এটা ঠিক। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠন সংবিধানের ব্যাপার এটাও ঠিক। কিন্তু সংবিধানের ভেতরে থেকেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের একটি রূপরেখা কামাল হোসেন দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তা ছাড়া বাকি দাবিগুলো তো বাস্তবায়নে আইন বা সংবিধান অন্তরায় নয়। তাহলে? একিউএম বদরুদ্দোজার নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা ও যুক্তফ্রন্ট অবশ্য সংলাপে খুশি। তারা শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করতে সম্মত আছেন, তবে নিরপেক্ষতা আশা করেন।

গত সোমবার ছিল জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ। এ সংলাপ নিয়ে দেশবাসী তেমন আগ্রহী নন। জাতীয় পার্টি আগে থেকেই সরকারের সঙ্গে আছে। তারা একাধারে বিরোধী দল, আবার সরকারি দলও। তাদের কাছ থেকে আর কতটাই বা আশা করা যায়? এটা ঠিক, এদেশে এর আগে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। যেখানে দুই নেত্রী কুশল বিনিময় পর্যন্ত করেন না, সেখানে এই সংলাপ রাজনীতিতে এক ইতিবাচক দিক নিঃসন্দেহে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই বলে আসছেন, তিনি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চান।

নির্বাচনে সেনা মোতায়েন, রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচন কমিশনকে ন্যস্ত করা, ইভিএম ব্যবহার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে দাবি উঠেছে। এ দাবি যে এই সংলাপের সময়েই করা হলো এমন নয়। বহুদিন ধরেই বিএনপি করে আসছে। চাইলে দু-চারটি মেনে নেওয়া যেত না এমনো নয়। নির্বাচন কমিশনের ওপর জনগণের তেমন আস্থা নেই। তাদের আমলে করা বেশ কয়েকটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। দুজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়েও কথা হচ্ছে বার বার। এই পরিস্থিতিতে সীমিত আকারে হলেও বিরোধী দলের দাবি মেনে নিলে গণতন্ত্রমনা আওয়ামী লীগ আরো বড় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারত।

এ কথা ঠিক যে, একটি সংলাপে সব সমাধান সম্ভব নয়। কারণ যেকোনো জটিল বিষয় সমাধানের জন্য একাধিকবার বসা প্রয়োজন। কিন্তু এ কথাও ঠিক, বার বার বসার সময় এখন আর নেই। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেকোনো দিন তফসিল ঘোষণা হতে পারে। ৭ তারিখে আওয়ামী লীগ আবারো বসছে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে। ওদিন তারা সংবিধানের আওতায় কিছু বিকল্প প্রস্তাব দেবে বলে আলোচনায় এসেছে।

সরকারি দলের কাছে সবারই প্রত্যাশা বেশি থাকে। এটা নতুন কিছু নয়। দেওয়ার ক্ষমতাও তাদের বেশি। এই সরকারের অধীনেই যদি নির্বাচন হয়, তাহলে সরকারকে যতটা নিস্পৃহ থাকতে হবে ততটাই জনগণ আশা করে। আওয়ামী লীগের গত দশ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। উন্নয়নের একটা রোডম্যাপও আমাদের সামনে রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে দেশে বেশকিছু সমস্যাও রয়েছে। আগামীতে সেগুলো কঠোর হাতে দমন করতে পারলে দেশ এগিয়ে যাবে এটা নিশ্চিত।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads