• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

একেই বলে সৌজন্যবোধ

  • শামীম শিকদার
  • প্রকাশিত ০৭ নভেম্বর ২০১৮

মানুষকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে বসবাস করার জন্য দলবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। সে দলবদ্ধতায় প্রত্যেকের নিজস্ব অবস্থান থেকে প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আলোকিত একটি সমাজ। সমাজে ধনী-গরিব, সাদা-কালো, হিন্দু-মুসলমান, প্রবীণ-নবীনদের পাশাপাশি অনেকেই বসবাস করেন। সুশৃঙ্খলভাবে বসবাসের জন্য অবশ্যই প্রত্যেকের নিজস্ব অবস্থান থেকে প্রত্যেককে সাহায্য-সহযোগিতা করা প্রয়োজন। সহযোগিতা ছাড়া কোনো শ্রেণিই একক প্রচেষ্টায় সুষ্ঠুভাবে গঠিত হতে পারে না।

পূর্বে সম্মিলিত প্রচেষ্টার অনেক চিত্র ফুটে উঠলেও বর্তমানে তার চিত্র অনেকটা বিপরীত ধরনের। এই বিপরীত চিত্রের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে পরশ্রীকাতরতা, শিক্ষা, শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের মতো শব্দগুলো। বর্তমান সময়ে সরকারে গভীর প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানুষ তাদের নিজেস্ব অবস্থান থেকে বের হয়ে শিক্ষার আলো দেখতে সক্ষম হচ্ছে। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে যোগদান করছে নামকরা কোনো প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তারা শিক্ষিত হয়ে বড় বড় ডিগ্রি নিলেও সিংহভাগ ব্যক্তির বিবেক অশিক্ষার অন্ধকার আলোয় নষ্ট করছে চলমান সমাজ। তারা এমন শিক্ষাই অর্জন করছে যেখানে বৃদ্ধ মা-বাবাকে যেতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। অসহায়ের মতো কাটাতে হচ্ছে তাদের অনিচ্ছাকৃত দৈনন্দিন জীবন।

অন্যদিকে পরিবার ছাড়াও আমাদের সমাজে এমন চিত্র প্রতিনিয়তই দেখা যায়। প্রবীণ ব্যক্তিদের সম্মান করার একটি প্রথা পূর্বে চালু থাকলেও বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতাম। বাধ্য হয়ে সাইকেল নিয়ে স্কুলে যেতে হতো। স্কুলে যাওয়ার পথে কোনো স্যারকে সামনে দেখলেই সাইকেল থামিয়ে তাড়াহুড়ো করে সাইকেল থেকে নেমে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে পুনরায় সাইকেলে উঠে চলে যেতাম। শুধু আমি নই, স্যারদের সম্মান দেখাতে গিয়ে সাইকেল থেকে দ্রুত নামতে গিয়ে অনেকে ব্যথাও পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষক-ছাত্র বন্ধু সম্পর্কের দোহাই দিয়ে বেয়াদবির চরম পর্যায়ে অবস্থান করছে। তাদের সামনে নানান ধরনের আপত্তিকর গল্প করার পাশাপাশি অনেকে টানছে সিগারেট। শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মতো সংবাদও গণমাধ্যমে বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। শুধু শিক্ষক নয়, সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে নবীনদের আচরণে তাদের অবমূল্যায়নের চিত্রই দেখা যায়। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে রাখা হয় সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের। যার পেছনে অর্থ বিশেষ ভূমিকা রাখে। নবীনরা মঞ্চের ওপর অবস্থান করলেও বৃদ্ধরা তাদের নিচের চেয়ারগুলোতে অবস্থান করেন। এর ফলে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা কোনো ব্যক্তিকে নয়, মূল্যায়ন করছে ব্যক্তির অর্থকে। অন্যদিকে আগে গ্রামের মধ্যে কোনো বিচার-সালিশ হলে বিচারক হিসেবে নির্ধারণ করা হতো গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের। তার কারণ হচ্ছে, মানুষ মনে করত প্রবীণদের অভিজ্ঞতার ফলে তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। কিন্তু বর্তমানে তার চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রবীণদের জায়গা দখল করে নিয়েছে গ্রামের কিছু কথিত রাজনীতিবিদ ও মাস্তান ছেলের দল। যাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে বিচারের নাম করে দুই পক্ষ থেকে কিছু অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। এমন চিত্র আমাদের সমাজে প্রচলিত বলে নতুন প্রজন্মও এই শিক্ষাই গ্রহণ করছে। সমাজকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার নির্দেশনা যদি প্রবীণদের কাছ থেকে নেওয়া যায়, তবেই আদর্শ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য প্রবীণদের সচেতন হতে হবে। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে যারা তাদের অহঙ্কারের কারণে নবীন ব্যক্তিদের সহজে সুযোগ করে দিতে চায় না। কর্ম থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নবীনদের অগ্রাধিকার কম থাকে; তাই বলে মন্দ ব্যবহার ও অসুস্থ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ করে তা বোঝানোর চাইতে স্নেহ করে তাকে তার অবস্থান বুঝিয়ে দেওয়া ওই সমাজের প্রত্যেকটি প্রবীণ ব্যক্তির অন্যতম দায়িত্ব। নিজের সম্মান নিজেকেই অর্জন করতে হবে; সেদিক বিবেচনায় নবীনদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন ও অগ্রাধিকার দিয়ে নিজের প্রাপ্যটুকু অর্জন করা সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ। একটি সমাজে বসবাস করতে সবার সম্মিলিত প্রয়াস ওই সমাজকে অনেক দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর দেশের প্রতিটি সমাজ যদি তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে যায়, তবে সে সূত্র ধরে দেশও তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে যাবে। শুধু প্রবীণরা সমাজের বা দেশের নেতৃত্ব দিয়ে সফল হতে পারবে, এমন নয়। নবীন বা তরুণদেরও সুষ্ঠু নেতৃত্বের গুণাবলি থাকতে পারে। তাই প্রবীণদের পাশাপাশি নবীনদের নেতৃত্বের সুযোগ করে দেওয়া প্রত্যেকটি প্রবীণ ব্যক্তির কর্তব্য।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads