• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

বুর্জোয়া মুক্তির আন্দোলন দরকার

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ১১ নভেম্বর ২০১৮

‘আমরা যে তিমিরে আমরা সে তিমিরে’ উনিশ শতকে বাংলার রেনেসাঁসকে নাকচ করে দিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় স্বীয় রেনেসাঁস ও রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধে এই কথাটি বলেছিলেন। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ-শতক পর আমাদের মনেও এমন কথাই জাগছে। ২শ’ বছরের বেশি সময় এই বাংলা শাসনের নামে নির্যাতিত ও শোষিত হয়েছে। এর আগে মোগল আমলে বাংলার সম্পদ দিল্লিকে মোটা-তাজা করেছে। ১৭০০ থেকে ১৭২৭ সাল পর্যন্ত মুর্শিদকুলি খাঁর সময় দিল্লিতে ১ কোটি থেকে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা পাঠানো হয়েছে রাজস্ব হিসেবে। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শায়েস্তা খাঁ দু মেয়াদে ২২ বছর সুবাদারি করে বাংলা থেকে দিল্লিতে ৩৮ কোটি টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব পৌত্র আজিমুস্সান ৯ বছরে ৮ কোটি টাকা বাংলা থেকে নিয়ে যান। (সূত্র : বাংলা বিভাজনের অর্থনীতি-রাজনীতি/সুনীতি কুমার ঘোষ) এসব টাকায় দিল্লিতে প্রাসাদ হয়েছে। হেরেমে চলেছে স্বর্গ ভোগ। এরপর ১৯০ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশে ছিলাম। ১৯৪৭-এ উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ২৩ বছর পাকিস্তানি ‘রক্তচোষা’ বুর্জোয়া শাসক গোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে নামতে হয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা একটা মানচিত্র পেয়েছি, স্বাধীন ভূমি পেয়েছি কিন্তু সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে টানা ২১৩ বছরের ঔপনিবেশিক ও বুর্জোয়া শাসনের ছলাকলা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারিনি। আগে ছিল বিদেশি বুর্জোয়া এখন দেশি বুর্জোয়া।

নতুন সমাজ ব্যবস্থার পূর্ব কথা হচ্ছে সমাজ বিপ্লব। এটা মনে রাখা দরকার যে, বিপ্লব মানে ধ্বংস নয়, নতুনের সৃজনক্ষেত্র প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থার আমূল কাঠামো পরিবর্তনের জন্য সে বিপ্লব হয়নি। উল্টো নতুন সমাজ গঠনের বিরুদ্ধে বিপ্লব হয়েছে, যা এখনো চলমান। বুদ্ধিবৃত্তিক লেখক আহমদ ছফার একটা কথা এখানে খুব প্রাসঙ্গিক মনে করছি। ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়— প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন— সেও ঠেলায় পড়ে।’ (বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস/ আহমদ ছফা) লেখক এখানে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বলেছেন, কিন্তু আমাদের শাসক শ্রেণিও এই বৃত্তের। এটা অস্বীকার করারও জো নেই। আর যদি করেনও তাহলে বিস্ময়ের কিছু নেই। তাদের মিথ্যার সাগরে এটা একবিন্দু মাত্র। ন্যায্য কথা বলার জন্য আগে পাকিস্তান পুলিশ পেটাত, গ্রেফতার করত এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পুলিশ পেটায়, গ্রেফতার করে। আগে রাজনৈতিক নেতাদের নানা কারণে গ্রেফতার করতে পাকিস্তান পুলিশ দরজায় কড়া নাড়ত, এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পুলিশ কড়া নাড়ে। সংবাদ মাধ্যমে কোন খবর ছাপা হবে আর কোন খবর ছাপা যাবে না, তা ঠিক করে দিত শাসকগোষ্ঠী। কড়া নিয়ন্ত্রণে ছিল সংবাদ মাধ্যম। এখনো তা থেকে পূর্ণাঙ্গ মুক্তি হয়নি। বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও লেখকদের দালালি, চাটুকারিতা, দলবাজি ও শাসকগোষ্ঠীর পুঁথিপত্র লেখার জন্য ছিল পুরস্কার। সাংবাদিকদের কিনে নেওয়ার জন্য ছিল ‘প্রেস ট্রাস্ট’। লেজুড়বৃত্তি, তেলামি, দালালি ও দলকানা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, মানবাধিকার ও নারী অধিকার কর্মী সেকালেও ঢের ছিল, একালেও তাদের পাল অনেক বড়। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যে শোরগোল হচ্ছে সে প্রেক্ষিতে এটা বলতে হয় যে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ নামে কুক্ষাত এই আইন সাংবাদমাধ্যমের দীর্ঘদিনের পাপের ফল।

জোট, ভোট ও ক্ষমতা- এই রাজনীতির বৃত্ত থেকে এখনো এদেশের জনগণ মুক্তি পায়নি। সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন অনেকে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই জোটের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? এমন জোট তো আগেও অনেক হয়েছে, নির্বাচন হয়েছে, ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে, কিন্তু এদেশের মানুষের ভাগ্য ও গণতন্ত্রের কোনো উন্নতি হয়নি। ক্ষেত্র বিশেষে যে উন্নতি হয়েছে তা ‘মন্দের ভালো’ বৈ কিছু না। ‘যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ’- আমরা এই রাবণের খপ্পরে বার বার পড়েছি। স্বাধীনতা উত্তর ১৯৭৪ সালে জোট হয়েছিল। সে জোটের ফল গণতন্ত্রের গলায় ছুরি মেরে ১৯৭৫ সালের বাকশাল। ১৯৭৮ সালে জোট হয়েছিল। সে জোটের ফলে সেনা ছাউনি থেকে গণতান্ত্রিক দল গঠন ও ভোটের নামে প্রহসন। ১৯৮৬ সালে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৫ দলীয় জোট ও বিএনপির ৭ দলীয় জোট হয়েছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সে জোটও টেকেনি। ১৯৯৯ সালের জোট ব্যাপক সফলতা পায়, কিন্তু ব্যর্থ হয় গণতন্ত্র। তা না হলে ‘এক-এগারো’ নামে কোনো কালো অধ্যায় আমাদের ইতিহাসে যুক্ত হতো না। ২০১০ সালে এসে বিএনপির জোট ১৮-দলীয় জোট, পরে ২০-দলীয় জোটে রূপ নেয়। আওয়ামী ১৪-দলীয় জোট মহাজোটে রূপ নেয়। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র কোনো উন্নত রূপ পায়নি।

গত ১ ও ৭ নভেম্বর গণভবনে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে এবং ২ নভেম্বর যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংলাপ আমাদের বর্তমান সংঘাতপূর্ণ, নৈরাজ্যময় ও পচন ধরা রাজনীতির জন্য শুভ দিক বলা যায়। তবে এ রকম সংলাপ আগে অনেক হয়েছে, কিন্তু ‘ক্ষমতার তালগাছ’ কেউ ছাড়তে চায়নি। যেমন- ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথের মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফানের মধ্যস্থতায় সংলাপ হয়েছে, তবে ফলপ্রসূ হয়নি। ১৯৯৫ সালে সংলাপ হয়েছে সেটাও সফল হয়নি। ২০০৬ সালের সংলাপ ও ২০১৩ সালের সংলাপও সফল হয়নি। অতীতের রেকর্ড ২০১৮-এর ঐক্যফ্রন্টের দু দফা সংলাপ নিয়ে ইতিবাচক আশা জাগায় না। তা ছাড়া জোটবদ্ধ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলগুলোকে এদেশের মানুষ হাড়ে-হাড়ে চেনে। ইতোপূর্বে তাদের যে রূপ এদেশের মানুষ দেখেছে তার চাইতে উন্নত কিছু হবে, এমন বিশ্বাস আসে না। সংলাপ পরবর্তী সময়ে যে তথ্য সংবাদমধ্যামে প্রকাশিত হয়েছে তাতে ‘বিচার মানি, তবে তাল গাছ আমার’-এর চাইতে বেশি অগ্রগতি দেখা যায়নি। দ্বিতীয়বারের সংলাপ গণভবনে আসা-যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। বিএনপি সংলাপ নিয়ে খুশি হতে পারেনি। খালেদা জিয়ার মুক্তি, ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, সংসদ ভেঙে নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়াসহ বেশকিছু বিষয় সরকার আমলে নেয়নি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের দাবিও আমলে নেয়নি। তেমনি যুক্তফ্রন্টের দাবিও গুরুত্ব দেয়নি সরকার পক্ষ। তাহলে ঐক্যফ্রন্ট ও যুক্তফ্রন্ট কী চাইল আর কী পেল- এই হিসাবে দলগুলো কতটা লাভবান? কোনো পক্ষই স্ব-অবস্থান থেকে সরেছেন বলে মনে হয়নি। তাহলে ওই যে ‘গণতন্ত্র রক্ষার জন্য দু’পক্ষের প্রত্যয়’ তা উজান বাতাসে জনতার চক্ষু লক্ষ করে ধুলা ওড়ানো বৈ কিছু নয়।

১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল এদেশের ‘পা ফাটা জনতার’ লড়াইয়ের মাধ্যমে। তাই বর্তমান আমাদের দেশের সর্বস্তরে সঙ্কট দূর করার জন্য আবার সে ‘পা ফাটা জনতার’ জাগরণ ঘটানোর বিকল্প নেই।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

ই-মেইল : ংধফরশরঁ০৯৯—মসধরষ.পড়স

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads