• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

দূষণ : আইন আছে প্রয়োগ নেই

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ১১ নভেম্বর ২০১৮

আমাদের দেশে পরিবেশদূষণের ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে, যখন বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে চোখ বুলানো যায়। আমাদের দেশে দূষণের শেষ নেই- শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, বর্জ্যের দূষণ, পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্য সঙ্কটাপন্ন। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তাদের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যত মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশ মৃত্যুই পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় ১৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ৮০ হাজার লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে এ দূষণের কারণে। আর গ্রাম-শহর মিলিয়ে এ সংখ্যা ২ লাখ ৩৪ হাজার। যা নাকি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চেয়ে দশগুণ। সড়ক দুর্ঘটনায় ওই বছর মৃত্যু হয়েছিল ২১ হাজার ২৮৬ জনের এবং নানা রোগব্যাধিতে ৮ লাখ ৪৩ হাজার। বায়ুদূষণজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা মোট মৃতের ২১ শতাংশ এবং সংখ্যায় তা ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৪০ জন, যা এক দশক আগের তুলনায় ১১ গুণের বেশি।

দূষণ আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এর মধ্যে আছে অপরিকল্পিত ইটের ভাঁটা, পুরনো গাড়ি, গার্মেন্ট বর্জ্য, ট্যানারি বর্জ্য, ইটিপিবিহীন কারখানা, পানি, বায়ু ও ভয়াবহ শব্দদূষণ। মানুষ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে পরিবেশ দরকার তা আজ আর অবশিষ্ট নেই। বিশ্বব্যাংকের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে, সমীক্ষার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা ভয়াবহ। দূষণের কারণে দেশে যে ক্ষতি হয় তা ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

শব্দ, নদী, বর্জ্য, যানজট, জলবায়ু ও খাদ্য ভেজালে বিশ্বে ১৬ শতাংশ, এশিয়ায় ১৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশে তা ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

দেশে ২০ বছরের পুরনো পরিবেশনীতি দিয়ে পরিবেশ আইন পরিচালিত হচ্ছে, যা দুঃখজনক। পরিবেশ নীতি ও আইন যুগোপযোগী করার আগ্রহ কারো নেই। কলকারখানায় শতভাগ ইটিপি চালু করলে পানিদূষণ অনেকাংশে কমে আসত, কিন্তু কারখানা মালিকদের চাপের মুখে তা হয়ে ওঠেনি। এ রকম প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে আনফিট গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নের শব্দদূষণে শহরাঞ্চলের মানুষ প্রায় বধির হতে চলেছে। আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের দৈন্যদশা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে।

পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে মানুষই যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শুধু তাই নয়। জীববৈচিত্র্যও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। মিল-কারখানা, গার্মেন্টসের বাহিত বর্জ্য নদীনালা খালবিলে পড়ে বহু প্রজাতির মাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

শব্দদূষণ একটি নীরব ঘাতক। এই ঘাতকের কবলে পড়ে শহরবাসী ৯টি ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন- হঠাৎ উচ্চশব্দ কানের পর্দায় আঘাত করলে তার প্রভাবে হূদস্পন্দন দ্রুত হয়, রক্তনালি সঙ্কুচিত হয়ে আস্তে আস্তে চোখের মণি প্রসারিত হয়। পাকস্থলি খাদ্যনালি ও শরীরে খিচুনিও দেখা দিতে পারে।

মানসিক অস্থিরতা এবং স্নায়ুবিক উত্তেজনাও বাড়ে। ফলে শারীরিক দুর্বলতা, বিরক্তি, ক্রোধ, উদ্বিগ্নতা, হতাশা, টেনশন, উত্তেজনা, অবসাদসহ নানান মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে বদহজম, পেপটিক আলসার, মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়া, হাড় ফেটে যাওয়া, অ্যাজমা বা হাঁপানি। শব্দদূষণ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়, যাতে ভবিষ্যতে মহামারীর মতো মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকার প্রথম শর্তই হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পরিবেশ। নিষ্কলুষ পরিবেশ মানুষ ও প্রাণিকুলকে রাখে সজীব, এমনকি পরিবেশের ভারসাম্য না থাকলে বনভূমিও উজাড় হয়ে যায়। আর এ জন্য প্রয়োজন সরকার, জনগণের সচেতনতা। প্রয়োজন পরিবেশ নীতিমালা সময়োপযোগী করে প্রণয়ন করা এবং প্রতিনিয়ত অভিযানের মাধ্যমে নির্মল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ জন্য সরকার, জনপ্রতিনিধি, এনজিও, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। ইউরোপে বর্জ্য নিক্ষেপের জন্য চার হাজার রিসাইকেল ইউনিট রয়েছে। এর মাধ্যমে মিথেন গ্যাস দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ভারতের অ্যাকশন প্ল্যানের হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি এক লাখ নাগরিকের জন্য এ ধরনের একটি ইউনিট স্থাপন করা হলে মাথাপিছু ২৫ টাকা ব্যয় হবে। আয় হবে ৩৬ টাকা। এতে প্রকল্প গ্রহণকালীন মাথাপিছু ১১ টাকা লাভ হবে। ঢাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ও শিল্প বর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য নিষ্কাশন, পাগলা পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগার, মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন, হাজারীবাগ ট্যানারি স্থানান্তর ও সেন্ট্রাল পরিশোধনাগার স্থাপন করে তার নির্গত গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। আগেই বলেছি, ইটিপি বা শিল্প কলকারখানার বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন বাধ্যতামূলক করা।

ঢাকা ঘিরে যে সমস্ত নদী-খাল তা পুনরুদ্ধার করা এবং ড্রেজিং বা খনন করে পানি প্রবাহ বাড়িয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে এখনো বক্স-কালভার্টগুলো খোলা হয়নি। ঢাকার বক্স কালভার্টগুলো খুলে দিলে ঢাকার বহু খাল উদ্ধার হবে এবং পানির ফোর্স বা প্রবাহ দিয়ে খালগুলোকে প্রবহমান করলে পরিবেশের উন্নতি ঘটবে। এবং জলাবদ্ধতা বা বৃষ্টি হলেই পানি না নামার কারণে সৃষ্ট জনভোগান্তির জলাবদ্ধতা নিরোধ হবে। যেমন হাতিরঝিলকে পরিবেশবান্ধব করা হয়েছে। ঢাকা এবং আশপাশের নদী, ভরাট খালগুলোকে পরিবেশবান্ধব করে তোলা এখন সময়ের দাবি। যদিও বক্স কালভার্ট খুলে প্রবহমান করার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এখন পালিত হয়নি। তা ছাড়া বহুবার হাইড্রোলিক হর্ন খুলে ফেলার নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি।

ইটভাঁটা তো ঢাকার আকাশ-বাতাস মেঘাচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ। গ্রীন ব্যাংকিংয়ের আওতায় অটোব্রিকস স্থাপনে ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকাররা কেন জানি উৎসাহী নন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলে সম্ভবত দেশের ১৫টি ব্যাংকের এ খাতে উদ্যোগী ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু কোনো অদৃশ্য কারণে গ্রীন ব্যাংকিংয়ের আওতায় তেমনভাবে অটো ব্রিকস কারখানা গড়ে উঠছে না।

পানি, বায়ু, শব্দদূষণ নগরবাসীকে নাকাল করে এখন এ দূষণগুলো গ্রামমুখী অভিযাত্রা শুরু করেছে। গ্রামবাংলার ঘর ঘরে পানি, বায়ু ও শব্দদূষণই নয়, খাদ্যে ভেজালের মতো দূষণ মানুষকে নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত করে তুলছে।

এ ছাড়া ইটাভাঁটায় ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জনসংখ্যার চাপে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বর্জ্যদূষণ সব মিলিয়ে মানুষের জীবন এখন আর নির্মল নয়, বিশুদ্ধ পানির মতো স্বচ্ছ নয়। দূষণে দূষণে মানুষের জীবন ঘুণে খাওয়া পোকার আক্রমণে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।

নীরোগ সুস্বাস্থ্য জীবনের জন্য, নির্মল পরিবেশের জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ এগিয়ে না এলে দূষিত পরিবেশের কারণে মহামারীর মতো মৃত্যুর ঢল নামবে দেশে দেশে। আমাদের এই নিজ দেশেও। সরকারকে জনস্বার্থেই নীতিমালা সংশোধন করে নতুন আইন প্রণয়ন করে প্রয়োগ করতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকার মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক-ভাগ মানুষ কানে কম শুনবে। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতা বলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। ওই বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিক্স, বাণিজ্যিক শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মান-মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রণীত এই বিধিমালা ভঙ্গ করলে প্রথমবার এক মাস কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। দ্বিতীয়বার এ অপরাধ করলে ছয় মাস কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড। এই আইন প্রচলিত। অথচ এর কোনো প্রয়োগ নেই। তদ্রূপ প্রকাশ্যে ধূমপান একটি অপরাধ সাজার কথা উল্লেখ আছে। অথচ প্রয়োগ নেই।

লোক দেখানো আইন করলেই হবে না। এর যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের পরিপার্শ্ব দূষণমুক্ত করতে হলে শুধু সরকারের দিক চেয়ে থাকলে চলবে না। সবাই মিলে দেশটাকে ভালোবেসে, মানুষকে ভালোবেসে যার যার জায়গায় থেকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমাদের সেই সমস্ত দরদি মানুষকে নির্বাচন করতে হবে বা জাতীয় সংসদে পাঠাতে হবে যারা নিজেদের স্বার্থ, দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করবেন। মানুষের কল্যাণে আইন প্রণয়ন করবে এবং তা প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। মানুষকে সুন্দর, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল নির্মল পরিবেশ উপহার দেবেন। দেশকে সম্পদের পাহাড় দিয়ে সমৃদ্ধ করলেই চলবে না, মানুষকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুন্দর জীবন, আনন্দঘন পরিবেশ দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও বিশ্লেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads