• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

চারদিকে ভোটের আওয়াজ

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ১৩ নভেম্বর ২০১৮

কোনো এক শহরে কেউ একজন যদি সন্তুর বাজায়, আর ঘোষণা করে ওইদিন পৃথিবীর সব মানুষের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, সবাই যা খুশি যেভাবে চায় সেভাবে তার ইচ্ছা প্রয়োগ করতে পারবে, নিজের কথাটা বলতে পারার সর্বোচ্চ শক্তি অর্জন করবে— তারপর আর কিচ্ছু তার থাকবে না!— অর্থাৎ শুধু একটি দিন সে তার ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার পাবে। এই ইচ্ছাক্ষমতা শুধু একদিন— ওইদিন। সেজন্য সন্তুরওয়ালা দৃশ্যত আজ খুব খুশি। একটা দিন তো! তারপর আবার কারাগার। আবার শৃঙ্খল। আবার হাতকড়া। সন্তুরওয়ালা ওই একটি দিন উপলক্ষে আজ সকাল থেকেই মন খুলে আসর বসিয়েছে। সেখানে অনেকরকম লোক এসেছে। খুব সুতীব্র আর সুখময় আজকের সকাল। কারণ, এটা অনেকদিন পর পাওয়া গেছে। আর অনেকদিন পরপরই এটা আসে এবং এমন আনন্দের ঘটনা ঘটে। ঘটনার ঘনঘটা আর হুল্লোড়ে এক মহৎ পরিবেশ আজ চতুর্দিকে। রমরমা সব মুখচ্ছবি। সবার ক্লান্তি আজ ঘুচে গেছে যেন। যেন অন্যরকম চলার শক্তি এখন— মনে ও মেজাজে। সন্তুরওয়ালা যে সুর তোলে তা ‘কার্নিভাল’। ওটা বাজিয়ে বাজিয়ে সে বলে, আজ মোদের বড় সুখের দিন। কিন্তু বেলা গড়িয়ে পড়ে যত— তত সুখ হারানো ভয়ের শঙ্কা সক্কলের কাঁধে চেপে বসে। দূরে দেখা যাচ্ছে কেউ শুকিয়ে গেছে। কেউ হারানোর ভয়ে এখনই পরাস্ত মুখে বিচ্যুত। সবকিছু যেন ঠিক আজকের সকালের সকলের মতো নয়। আবার সেই ম্রিয়মাণ মেলা। তখন সন্তুরওয়ালা বলে, সব তোমাদের লুট হয়ে গেছে আজ। যাবতীয় অনেক কিছু এমনকি শেষ সম্বল যে নিজের ইচ্ছে, তাও লুট হয়ে গেছে। মনের অজান্তে সব দিয়ে দিয়েছ তো— তাই এখন আর কিছু করার নেই। তখন একজন প্রশ্ন করে, তবে সকালে যে এত আনন্দ হচ্ছিল? উত্তরে সন্তুরওয়ালা বলে, পাগল— আনন্দই তো মানুষের গান! সেজন্য সবাই আনন্দ চায়। কিন্তু ওটা কেউ মেনে নেয় না। তাই আনন্দ অমান্য হয়ে গেলে সূর্যের দ্যুতি কমে যায়, মন মরে যায়। তখন ওই মেকি আনন্দও আড়ালে হাসে আর গানের জন্য ভাসে। এই যে সন্তুর— তা শুধু ঐক্যের কথাই তুলে ধরে। সেটা কেউ বোঝে না। ঐক্যও বোঝে না। আবেগের আড়ালে সে সর্বোচ্চ বাস্তব শক্তি-সংহার করে এর মধ্যে।

তবে একদিনও কী এমন ছিল এই বাংলাদেশে, যেখানে সন্তুরওয়ালার ঐক্য-রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মানুষগুলো সত্যিই আনন্দ করবে এবং তা হারানোর জন্য কখনো কষ্ট পাবে না। বুঝি হয়নি কোনোদিন। আর হবে কি-না তাও আমরা জানি না। আবার এটাও সত্য যে, হয়তো ওই আনন্দ উপভোগের শক্তি এদেশের কারো নেই। যোগ্যতাও নেই। কোনোরকম কিছু বোঝার বা ধারণ করার শক্তিও নেই। সেজন্য সব্বাই বোকা বানায়। বোকা বানানোর আড়ালে কত কী ফন্দি করে। ভোট চায়। ভোটাধিকার পয়দা করে। সেজন্য ওদেরই অনেক অর্থ খরচা করে আইডি বানায়। এসব ট্রান্সপারেন্ট হওয়ার জন্য নানারকম ফন্দি-ফিকির। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। বড় বড় আলিশান কাণ্ডকারখানা হয়, সভা হয় সমিতি হয় মিটিং হয়, বলা হয়, ফাটিয়ে দেওয়া হয়— জনতার কথা বলে বলে, জনগণের কথা, জনগণের অধিকার, ধর্ম-বর্ণ-জাতি রক্ষার অধিকার কত কী! আদতে কিছুই হয় না। সন্তুরওয়ালার সুর ভালো লাগে, কিন্তু সে সুর যে ফ্যাকাশে হতে সময় লাগে না! রগরগে সুর, উন্মাতাল করার সুর তা কতক্ষণ, বেশিক্ষণ তো চিত্তে স্থায়ী হয় না!

আটচল্লিশ বছর আগে ১৯৭০ সালে ভোট দিয়ে যখন দেশ-বস্তু ক্রমশ দৃশ্যমান হয়, তখন ‘আমরা সবাই বাঙালি’ কথাটি ছিল। সেখানে এক হওয়া, সমান করা, সমঅধিকার করা— সেজন্য আইন বানানো, বিচারব্যবস্থা তৈরি, প্রশাসন ঢেলে সাজানো, স্বপ্নময় সমাজতান্ত্রিক আদর্শসহ— সবই ছিল। কিন্তু ‘ছিল’ তো আর বর্তমান নয়? ছিল-টা ছিলই না, পরিশেষে তা আছে হয়নি। আছে-তে পর্যবসিত হয়নি। ছিল-কে বাস্তবে পরিণত করার শক্তি এ রাষ্ট্র কখনোই পায়নি। আজো পায়নি। খুব কথা হয়, জনগণ নিয়ে। সর্বত্র। বিরোধীরা জনগণের দোহাই দেন, সরকারেরও। বিরোধীরা তো এখন জনগণের খুব কাছের! খুব উপদেশ দিচ্ছেন, নেমে পড়ুন, রাস্তায় আসুন, ত্যাগ করুন। কেন? কারণ, ওদের ঘাড়ে পা দিয়ে একবার গদিনসীন হলে— তারপর আর পায় কে? এখন বোধকরি জনগণও বুঝে গেছে এসব! সেটা যতই কমবেশি রকমের হোক। ধোঁকা আর প্রবঞ্চনা যে কতরকম তা আর কার না জানা!— আর কেউ যে তাদের ভাগ্য ফেরাবেও না তাও জানে। সেটা বহুকাল তারা দেখে আসছে। ওই ভাগ্যের চাকাটা নিজেকেই ঘোরাতে হয়। কত কষ্টে তা ঘোরানো চলে! শীতে-গ্রীষ্মে-বর্ষায় একতালে। একলয়ে চলছে, কাজ কাজ আর কাজ। মাঠের কাজ, ময়দানের কাজ, বহুদূর হেঁটে গিয়ে কাজ। কাজের অন্বেষণ, সে অন্বেষণ শেষ হয়নি। হয় নাই। সুখ তাদের বুঝি সহ্য হয় না। সুখ তারা নিতেও চায় না। পারেও না। কাজ-কর্ম না থাকলে ঠিক চলে না যেন! কর্মপিপাসুই তাদের জীবন। এই যে শ্রেণিহীন, অন্ত্যজ, প্রান্তিক, জনমানুষ— ওদের জাত-পাত নেই। অসততা নেই। প্রাপ্যটুকু চায়। কিন্তু এই প্রাপ্য তারা আদায় করতে পারেনি। প্রাপ্য বোধকরি পেতেও জানে না। পাওয়ার জন্য যা দরকার তা সত্যও হয়নি। আশ্চর্য এ মন তাদের। ভাঙে না। পরিবর্তন হয় না। ভাগ্যের চাকা এক তালে এক লয়ে চলছে তো চলছেই। ঠিক বিপরীতে তাই ওদের নিয়ে রাজনীতি করা সহজ হয়। এসব মানুষকে পুঁজি করাও সহজ। শিক্ষিত মানুষ আজকাল ‘জনগণ’ কথাটায় বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর ভাগ্যের চাকা বদলানো সাধারণ মানুষজন ওসব কানে নেয় না। বোঝেও না। বুঝলেও জানে ওসব কিছু হবে না। বাজে কথা। বঙ্গভবনে জনগণ নিয়ে কথা হলে, কে বিশ্বাস করে— যে ওটা বাস্তব! গণভবনে জনগণ নিয়ে কথা হলে ওটা যে সত্য এবং সে সত্য যে চোখে দৃশ্যমান হবে— সেটা কে বিশ্বাস করে! কিন্তু কথাটা হয়, হবে; বিশ্বাস পয়দা হোক বা না হোক, ওই কথার ঘোড়ায় চড়ে কেউ কেউ অনেক দূর যাবেও, অনেক কিছু পেয়ে যাবে, অনেকভাবে আত্মসুখ, চিরসুখের মালিক হবে কিন্তু যার জন্য কথা তার কিছু হবে না— সে বেপথুই থেকে যাবে— ওই যেমন ছিল তেমনই। ভাগ্যের চাকা আর রথের চাকা কিংবা লাল কর্দমাক্ত আটকে যাওয়া পুরনো ভাঙা দ্বিচক্রযানের পরিত্যক্ত চাকা (এ চাকার কাহিনী গ্রামগঞ্জে একসময় ছিল এখন ‘উন্নয়ন’-অর্থে তা বাজেয়াপ্ত) ওই একইরকম। তাই এদের কথা সব অভিজাত ভবনেই শুধু নয়, ওয়েস্টিনে-সোনারগাঁওয়ে-র্যাডিসনেও কথা হবে, বহু কথা হবে, হতেই থাকবে। এবং রাস্তাতেও হবে। ভবঘুরে কিছু মানুষ চিরকাল যারা লালপতাকা বয়ে বেড়ান, তারাও একই কথা বলেন। কিন্তু কোনটা ভান আর কোনটা ভান নয়, সে চিহ্নায়ন তো আজো পরিষ্কার হয়নি। এই কূলহীন কুলটা জনগণ এখন তবে তুরুপের তাস— এই চলছে— এটা বোঝা যতটা সহজ ততটা মুশকিল। এসব আদ্যোপান্ত ইতিহাসকথন বার্তা নিয়ে এখন সন্তুর-সকাল উজ্জীবিত, যার আসল নাম ‘৩০ ডিসেম্বর’। সেদিন সন্তুরওয়ালা ঐক্যের জন্য তার রাগ বাঁধিবেন। এবং আমজনতা ওইদিন কলহাস্যে মাতিয়া উঠিবে।

তফসিল ঘোষণার পর এখন একটু ঠান্ডা হাওয়া প্রবহমান। কোথাও কোনো শব্দ নেই যেন। পরিণতি কোনদিকে, বাতাস কোনমুখো সেটি অপেক্ষায় প্রহরারত। আসলে কিছুই তো হওয়ার নেই। সবই চলমান সিরিজ নাটক। এবং মঞ্চস্থ নাটকে হ্যামলেটের পরিণতি কোন প্রান্তমুখ স্পর্শ করবে সেটা নিয়ে দর্শকের আহ্বান আছে, উদ্দীপনা আছে কিন্তু ঘটমান বর্তমান তো ঘটিয়া যাইবেই, তবে মানুষ যা আছে তা-ই থাকিবে। বারবার বলি, রাজনীতিটা চাই। মানুষের রাজনীতি। সেটা এখনো অনেক দূর। কে এদেশে সেই পরিশুদ্ধ কাজটি সম্পন্ন করিবেন, কীভাবে করিবেন, কেউ তা জানে না। কবে হবে, কীসের মধ্য দিয়া হবে তাও জানা কঠিন। এই ‘কাঠিন্য’ প্রত্যাশা কোন মুদ্রিত মুণি কীভাবে দেখিতেছেন তা অজানা। তবে নিশ্চয়ই তা মানুষকুল একদিন এই দেশে এই পথ খুঁজিয়া পাইবেন। সে প্রত্যাশা অকুণ্ঠরূপে অধীত আছে। সুতরাং ভাগ্যের চাকা টানার ভেতরেই ভাগ্যের গ্রন্থন সুগঠিত। হয়তো এসব প্রত্যাশা ভাবপ্রসূত মনে হইবে কিন্তু আসমুদ্রহিমাচল সকল মানুষ এখনো এই ভাগ্যের চাকার ওপরই বসবাস করিতেছে। এবং তাহাতেই আস্থা প্রবল। এই প্রাবল্য ধারণ করে আছে ‘মানুষ’। এই ধারণার ভেতরেই সম্প্রীতি-সম্পর্ক-আদর্শ-পরামর্শ নিহিত। ধর্ম বলি অবিচল আস্থার ক্ষেত্র বলি, তা-ই তো মানুষ! মানবতা-মনুষ্যত্ব কিংবা মানুষের রাজনীতিও তাহার মধ্যেই লুক্কায়িত। একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করি : ‘সব যুগই একরকম নয়। কোনও কোনও যুগে মানুষের রুচি-বুদ্ধির যথেষ্ট বিকার দেখা যায়। স্বভাবতই ভালো বলা যেতে পারে না, তবু মোটামুটি মঙ্গলপ্রেরণা আছে মানুষের। সেটা না থাকলে উপনিষদ তৈরি হতে পারত না, অথবা মহাভারত; বৃদ্ধ-অশোকের রাষ্ট্র, নির্মল ক্রিশ্চান উন্মেষ সম্ভব হতো বলে মনে হয় না; পশ্চিমি শাসনসভ্যতার সৎ আইন-কানুন সব— বিশেষত রোম-এ যা হয়েছিল এবং অনেক পরে ইংলন্ড-এ— সে-সবের প্রণয়ন ও গ্রহণের কথাই উঠতে পারত না... সভ্যতা ও সিদ্ধিলাভের ক্ষমতা মানুষের আছে মনে হচ্ছে।...’— কথাটি বাংলা ভাষার আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশের। এমনটা অবিশ্বাস করতে কখনো মন চায় না।

 

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads