• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

একটি শিক্ষাবিষয়ক স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক

  • মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশিত ১৪ নভেম্বর ২০১৮

‘শিক্ষা’ যে একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানক্ষেত্র সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ দূরে থাক আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিতদের একটি বিশাল অংশই অজ্ঞাত। জরিপে হয়ত এর পরিমাণ ৮০ বা ৮৫ শতাংশ পেরিয়ে যাবে। বাংলাদেশে শিক্ষারত শিক্ষার্থীরা দেশের মধ্যে নিজেদের আভিজাত্য দিনে দিনে রঙিন করেই চলেছে, শিক্ষকতাসহ ও নিজেদের প্রচেষ্টায় দেশের বড় আসনগুলো দখল করে নিচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষামূলক উদ্যোগের পাশাপাশি অন্যান্য সেক্টরেও ক্যারিয়ার গড়ছে।

‘শিক্ষক শিক্ষা’ হলো শিক্ষাবিজ্ঞানেরই একটি অংশ। এ দুটি বিষয়ের মধ্যে যে ব্যবধান তা সহজে বোঝানোর জন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ‘শিক্ষা’ এবং ‘শিক্ষক শিক্ষা’ দুই নামে দুটি ডিগ্রি পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। কেননা বিষয়টি সবার কাছে সহজেই বোধগম্য হয়। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা করলে মন্দ হয় না, বরং এক্ষেত্রে মানুষের বিভ্রান্তি দূর হবে। পাশাপাশি এর ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রসমূহ সম্পর্কেও মানুষ জানতে পারবে বা ভবিষ্যতে আগ্রহ প্রকাশ করবে। বেশি ভালো হয় যদি আমাদের দেশে একটি শিক্ষাবিষয়ক স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি আমাদের এখন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষিবিষয়ক ভিন্ন ভিন্ন পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কিছু উদ্দেশ্য।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এবং সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত শিক্ষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, মিসরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের বিশেষ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইনস্টিটিউট বা ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বাইরের শিক্ষার্থীদেরও ডিগ্রি প্রদান করছে। বাংলাদেশ সরকারও দেশের ও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্বার্থে লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রতিবছরই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পাঠিয়ে থাকে। এ থেকেই এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের গুরুত্ব বোঝা যায়।

বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ইনস্টিটিউট রয়েছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ নামে আলাদা ফ্যাকাল্টি চালু করা হয়েছে। এসব ইনস্টিটিউট, কলেজ, ফ্যাকাল্টি থেকে শিক্ষা বিষয়ের ওপর বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, যেমন—ব্যাচেলর অব এডুকেশন (১-৪ বছর), মাস্টার্স অব এডুকেশন (১ বছর), ঢাবিতে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স (১-২ বছর) ইত্যাদি। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও এ সুযোগ প্রদান করছে।

কাউকে শিক্ষক হতে গেলে বা শিক্ষকতায় ক্যারিয়ার গড়তে গেলে সবারই শিক্ষায় কোনো ডিগ্রি থাকা আবশ্যক বলেই গণ্য করা হয় বহির্বিশ্বে, হোক সে প্রাথমিক বিদ্যালয় কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশেও এই ডিগ্রি অর্জন করতে হয়, তবে তা উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য নয়, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বা বিসিএসের মাধ্যমে যারা শিক্ষকতায় প্রবেশ করেন। বিএড ডিগ্রি শুধু তাদেরই অর্জন করতে হয় যারা বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও প্রাথমিকের শিক্ষক হতে চান। এক্ষেত্রে শিখন-শিক্ষণ কৌশল (শিক্ষার্থীদের শ্রেণি, বয়স, জ্ঞানস্তর ও বিষয় অনুসারে), পেডাগজি, শিক্ষা-মনোবিজ্ঞান, পাঠ পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট বিস্তারিত ধারণা ও এর ব্যবহার, শ্রেণি ব্যবস্থাপনা, সঠিক উপকরণের সঠিক ব্যবহার, শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি, অভীক্ষা পদ ও পত্র প্রণয়ন, মার্কিং, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, শিক্ষাক্ষেত্রে নেতৃত্ব, পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতাসহ যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকা প্রয়োজন।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে বিভিন্ন বিতর্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই বিতর্ক সৃষ্টির মূলে আপাতদৃষ্টিতে প্রধান কারণ হিসেবে রয়েছে ভালো শিক্ষা বিশেষজ্ঞের অভাব। যে কারণে সরকারি শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন প্রজেক্টে বিদেশি শিক্ষাবিদদের দেখতে অভ্যস্ত। স্বদেশ ও বিদেশের শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ও খুব ভালো ফল এনে দিতে পারছে না, যার প্রমাণ হিসেবে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান বিতর্ককে সামনে আনতে পারি। যেমন—বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়; অথচ বেশিরভাগ শিক্ষকই জানেন না বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীভাবে কাজ করতে হয়। যারা মোটামুটি জানেন, তারাও নিজেদের জ্ঞানকে প্রয়োগ করতে পারছেন না উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে। তারা ভালো মানের প্রশিক্ষণ পাবেন কীভাবে যদি ভালো মানের প্রশিক্ষক তৈরি করা না যায়। আজ এ অভাববোধ হয়তো হতো না যদি আমাদের একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় থাকত। শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নির্ধারিত একডেমিক ও প্রশিক্ষণগত কাজের পাশাপাশি কনটিনিউয়াস গবেষণার মাধ্যমে সরকারের শিক্ষানীতি উন্নয়ন/সংশোধনসহ এ সংক্রান্ত নানাবিধ তথ্য প্রদান করে সহায়তা করতে পারে। উচ্চ শিক্ষার প্রসারে প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। তাই বলছি, অন্তত একটি শিক্ষা স্পেশালিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক, সেটি হতে পারে বাংলাদেশের যেকোনো জেলায়। আশা করছি আমাদের সরকার ও প্রশাসন বিষয়টি ভেবে দেখবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads