• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

দেশে জোবায়দা ভারতে প্রিয়াঙ্কা

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৪ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে সম্প্রতি একই সময়ে দুজন নারীর যুক্ত হওয়ার খবর নিয়ে জোর জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে বিপন্ন বিএনপির হাল ধরতে আসছেন ডা. জোবায়দা রহমান। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ এবং দণ্ডিত অবস্থায় লন্ডনে বসবাসরত তারেক রহমানের স্ত্রী। তার পিতা সাবেক রিয়ার অ্যাডমিরাল মরহুম মাহবুব আলী খানও দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

লেখাপড়ায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য ডা. জোবায়দার বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। প্রচারণা যারা চালাচ্ছেন তারা মনে করেন, ডা. জোবায়দা যদি বিএনপির হাল ধরেন এবং নিজে প্রার্থী না হয়েও বিএনপির পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন, তাহলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে দলটি অনেক ভালো করবে। দলের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠবেন। বেগম খালেদা জিয়া বন্দি হয়ে পড়ায় এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে নিন্দা ও নেতিবাচক মনোভাব বেড়ে চলায় দলের ভেতরে যে নেতৃত্বের সঙ্কট ও শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তার অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারবেন ‘ক্লিন ইমেজের’ ডা. জোবায়দা। উল্লেখ্য, বহুদিন ধরেই তার রাজনীতিতে আসার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু প্রতিটি উপলক্ষেই জানানো হয়েছে, ব্যক্তিগতভাবে ডা. জোবায়দা ইচ্ছুক বা আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দলের বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নাকি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে সম্মত হয়েছেন।

অন্যদিকে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারানোর পর তারই বড় ছেলে রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রিয়াঙ্কা সেই রাজীব গান্ধীর একমাত্র মেয়ে। পিতা রাজীব এবং দাদি ইন্দিরা গান্ধীরও আগে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন প্রিয়াঙ্কার দাদির পিতা জওহরলাল নেহরু। প্রধানমন্ত্রী নেহরুই ভারতের রাজনীতিতে ‘গান্ধী পরিবারের’ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

দেশটির সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি পদে এ পর্যন্ত যে ১৫ জন বসেছেন তাদের মধ্যে ওই একটি পরিবার থেকেই এসেছেন পাঁচজন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬ সাল থেকে এবং ইন্দিরার ছেলে ও প্রিয়াঙ্কার পিতা রাজীব গান্ধী ১৯৮৪ সাল থেকে আট বছর করে কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। প্রিয়াঙ্কার মা সোনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেসের সভাপতি করা হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। দীর্ঘ ১৯ বছর পর গত বছর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সোনিয়া সভাপতি পদ থেকে সরে গেছেন। পদটিতে বসিয়েছেন ‘গান্ধী পরিবারের’ ষষ্ঠ সদস্য এবং নিজের ছেলে রাহুল গান্ধীকে।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। কারণ, ভাই রাহুল গান্ধীর বয়স তখন মাত্র ৪৮ বছর। অন্যদিকে ১৩২ বছরের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল। ভারতের ক্ষমতায় সবচেয়ে বেশি সময়ও ছিল কংগ্রেস। অবস্থায় পরিবর্তন ঘটেছিল রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর। নরসীমা রাও ও সীতারাম কেশরীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল বলেই ১৯৯৮ সালে অনিচ্ছুক ও রাজনীতিতে অপরিপক্ব সোনিয়া গান্ধীকে সভাপতি বানানো হয়েছিল। কংগ্রেস তখন চারটি মাত্র ক্ষুদ্র ও কম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল। বিজেপি নেতা প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স-এনডিএ জোটের প্রচণ্ড দাপটের বিরুদ্ধে রীতিমতো লড়াই করেছিলেন সোনিয়া গান্ধী।

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সোনিয়ার নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরাট বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। ২০০৯ সালের নির্বাচনেও কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত ইউনাইটেড পিপ্লস অ্যালায়েন্স বা ইউপিএ জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছিল। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় কংগ্রেস একাই জিতেছিল ২০৬টি আসনে। সেবার সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি উঠেছিল জোরেশোরে। কিন্তু বিজেপির কঠোর বিরোধিতার মুখে সোনিয়া গান্ধী পিছু হটেছিলেন। যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেছিলেন, তার ‘অন্তরাত্মা’ নাকি তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে নিষেধ করেছে!

নিজে সরে গিয়ে সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন ড. মনমোহন সিংকে। কিন্তু ইউপিএ তথা কংগ্রেস সরকার ক্রমাগত ব্যর্থতার নজির স্থাপন করেছে। একযোগে শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের পতন। সেই সুযোগে দ্রুত সাফল্যের পথে এগিয়ে এসেছিল বিজেপি। হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই জিতেছিল ২৮২টি আসনে। অন্যদিকে কংগ্রেস এমনকি প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানেও যেতে পারেনি। কেন্দ্রে শুধু নয়, রাজ্যগুলোতেও কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বরং বেশকিছু রাজ্যে দলটি ক্ষমতা হারিয়েছিল। কংগ্রেস একই সঙ্গে প্রধান দলের অবস্থানও খুইয়ে ফেলেছে। 

দলের এমন এক শোচনীয় অবস্থায় রাহুল গান্ধীর মতো মাত্র ৪৮ বছর বয়সী একজন তরুণ নেতাকে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করায় ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। প্রতিক্রিয়ার একটি বড় কারণ হলো, ‘মোদি জোয়ারে’ ভেসে চলা ভারতে বিজেপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য কংগ্রেসের নেতৃত্বে এমন একজনের প্রয়োজন ছিল যার সঙ্গে কাজ করতে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের মতো প্রবীণ নেতারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। বিজেপিবিরোধী প্রধান জোট ইউপিএর নেতৃত্বও যেহেতু কংগ্রেসের হাতেই রয়েছে ও থাকবে সেহেতু দলটির সভাপতি পদে প্রবীণ কাউকেই আশা করেছিল জোটভুক্ত দলগুলো। এতদিন সোনিয়া গান্ধী ইউপিএর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার স্থলে রাহুল গান্ধী মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারেননি। প্রশ্ন উঠেছিল রাহুলের যোগ্যতা নিয়েও। এসব সত্ত্বেও ‘গান্ধী পরিবারের’ সদস্য বলেই রাহুল গান্ধীকে নিয়ে কংগ্রেসের ভেতরে কোনো দ্বিধা বা বিরোধিতা লক্ষ করা যায়নি। প্রশ্ন ও সংশয় থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসের সভাপতি পদে রাহুল গান্ধীর নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে ইতিহাসের আলোকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।

রাহুল গান্ধীকে নিয়ে কংগ্রেস ও বিজেপির পাশাপাশি সাধারণভাবে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট আলোড়ন উঠলেও একজন প্রধান নেতা হিসেবে তিনি কিন্তু তেমন সাফল্য দেখাতে পারেননি। বিগত দুটি লোকসভা নির্বাচনেই সোনিয়া গান্ধী অঘোষিতভাবে রাহুল গান্ধীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি রাজ্যসভার নির্বাচনের সময়ও রাহুল গান্ধীকেই প্রধান নেতার ভূমিকায় দেখা গেছে। কিন্তু কোনো নির্বাচনেই তিনি কংগ্রেসের ভরাডুবি ঠেকাতে পারেননি। যেমন চলতি বছর ২০১৮ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরার নির্বাচনে দলটির ভোট আগেরবারের ৪২ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে মাত্র এক দশমিক আট শতাংশে। অন্যদিকে ঠিক উল্টোটি ঘটেছে বিজেপির ক্ষেত্রে। আগেরবারের পাওয়া এক দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে এক লাফে বেড়ে বিজেপি এবার পেয়েছে ৪৩ শতাংশ ভোট। আরেক রাজ্য কর্নাটকে রাহুল গান্ধী অবশ্য সাফল্য দেখিয়েছেন। মে মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত বিধান সভার নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। এই সুযোগে তৃতীয় দল জেডিএসের সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষমতায় গেছে কংগ্রেস। কিন্তু এজন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদটি দিতে হয়েছে জেডিএসের এইচডি কুমারস্বামীকে।

এ ধরনের পর্যায়ক্রমিক ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেই রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সম্ভাবনা নিয়ে ব্যাপক পর্যালোচনা শুরু হয়েছিল। কোনো প্রতিক্রিয়াই রাহুলের পক্ষে যায়নি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও মনে করছেন না যে, রাহুলের নেতৃত্বে ২০১৯ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনে জিতে কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হতে পারবে। দলটি ক্রমাগত বরং আরো পিছিয়ে পড়বে। এমন এক ভাবনা ও চিন্তাগত উপসংহারের কারণেই প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নেতৃত্বে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রিয়াঙ্কা অবশ্য অনেক আগে থেকেই কংগ্রেসের কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন। বিশেষ করে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সময় তাকে মা সোনিয়া এবং ভাই রাহুলের পাশে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু কংগ্রেসের বর্তমান দুঃসময়ে এটুকু ভূমিকাকে যথেষ্ট মনে করা হয়নি বলেই প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সরাসরি কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের হাই কমান্ড। বড় কথা, বহু বছর পর প্রিয়াঙ্কা নিজেও সম্মত হয়েছেন বলে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে; (দেখুন : ‘রাজনীতিতে আসছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী!’ শিরোনামে দৈনিক বাংলাদেশের খবরে প্রকাশিত রিপোর্ট, ১২ নভেম্বর, ২০১৮)।

বলা দরকার, ভারতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর এবং বাংলাদেশে ডা. জোবায়দা রহমানের নেতৃত্বে আসার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে রয়েছে একই পরিবারতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতি। এ দুটি জল্পনাকল্পনা বা খবরের মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, ভারতে ন্যাশনাল কংগ্রেস যেমন পরিবারতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তেমনি বাংলাদেশেও বিএনপি আটকে রয়েছে পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উদাহরণ না টেনেও বলা যায়, উভয় দেশেই এখনো ‘একজন’ নেতাকেন্দ্রিক দলের বিকাশের তত্ত্বটিই সমানভাবে সত্য।

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads