• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

টেকসই উন্নয়নে যুবসমাজ

  • মুহম্মদ র ই শামীম
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০১৮

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের নতুন চ্যালেঞ্জ এখন আমাদের সামনে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সফলভাবে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পূরণে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, এমডিজি অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে গণ্য হয়েছে। এমডিজির সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এসডিজি বাস্তবায়ন এখন আমাদের সামনে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, এমডিজির চেয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জসমূহ অনেক বেশি। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশের জন্য এসডিজি বাস্তবায়নে অনেক সম্ভাবনা বা সুযোগও রয়েছে। কারণ আমাদের রয়েছে মূল্যবান মানব সম্পদ।

মানব সম্পদ যেকোনো দেশেরই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর মানব সম্পদের মধ্যে সবচেয়ে কর্মঠ, সৃজনশীল, সক্রিয় এবং মূল্যবান অংশই হলো যুব সম্পদ। বাংলাদেশ এখন মানব সম্পদের শ্রেষ্ঠ এই অংশের সোনালি সময় পার করছে। কারণ আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩২ ভাগই এখন যুব। যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের প্রধান পুঁজি হিসেবে গণ্য হতে পারে। এটা এখন আমাদের ‘ডেমোগ্রাফিক ডিডিডেন্ড’। আমাদের সামনে এখন এসডিজি বাস্তবায়নে এই যুব সম্পদকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ দেখা দিয়েছে। তাই এই যুব সম্পদের মতো মানব সম্পদকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সম্পদে পরিণত করতে পারার ওপর নির্ভর করছে আমাদের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন। সারা বিশ্বে উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নে যুবরাই প্রধান ও মূল্যবান অংশীজন হিসেবে আজ স্বীকৃত। শুধু টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন নয়, যেকোনো উন্নয়ন ও কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতিসংঘসহ প্রতিটি উন্নত রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, নীতিনির্ধারক এবং সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে তাই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র তথা নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে যুবদের সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হিসেবেই এখন বিবেচনায় নেওয়া হয়। তাই এসডিজির লক্ষ্য পূরণে যুব সমাজই হলো আমাদের প্রাণশক্তি। এমডিজির লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ অনুসরণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশকে বলা হয় এমডিজির ‘রোল মডেল’। ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল’ (এমডিজি) বা সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময় শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা ছিল আটটি। ১. চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল, ২. সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন, ৩. জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারীর ক্ষমতায়ন, ৪. শিশু মৃত্যুহার কমানো, ৫. মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন, ৬. এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া এবং অন্যান্য রোগব্যাধি দমন, ৭. পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ এবং ৮. সার্বিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা। এমডিজির সাফল্যের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এখন এসডিজি বাস্তবায়ন করছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হলো আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত একগুচ্ছ ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা। জাতিসংঘ কর্তৃক এ লক্ষ্যমাত্রা প্রণয়ন করা হয়েছে। এসডিজির মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০৩০ সাল। এতে মোট ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা ও ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট টার্গেট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রাসমূহে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ১৯৩টি দেশ একমত হয়েছে। এসডিজির ১৬৯টি টার্গেটের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ টার্গেটের সঙ্গে যুবদের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এসডিজির লক্ষ্যগুলোর মধ্যে সরাসরি যুবদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যুবরাই অন্যতম অংশীজন (স্টেকহোল্ডার) যেমন- দারিদ্র্যবিমোচন, জেন্ডার সমতা, কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি, মানসম্মত শিক্ষা এবং জলবায়ু বিষয়ে পদক্ষেপ।

এসডিজির লক্ষ্য-আট অনুযায়ী উৎপাদনশীল ও উপযুক্ত কাজের সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এটা অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। তাই যুবদের বেকারত্ব নিরসন বা সম্মানজনক কাজের ব্যবস্থা সারা বিশ্বের জন্যই এসডিজি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের বেকার যুব গোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগই প্রায় দেশে বাস করে। এই চ্যালেঞ্জ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আরো ব্যাপক ও কঠিন। অথচ এসডিজি বাস্তবায়নে এই যুব গোষ্ঠীর জন্য যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে এক-তৃতীয়াংশই যুব সমাজ। এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ নতুন যুবশ্রমিক শ্রম বাজারে যোগ হচ্ছে।

আশার কথা যে, এমডিজির সফলতার ধারাবাহিকতা নিয়ে বাংলাদেশ এসডিজি বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই সরকারের ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজির লক্ষ্যসমূহ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সব মন্ত্রণালয়কে অন্তর্ভুক্ত করে সমন্বিত আকারে লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সব মন্ত্রণালয়কেই লক্ষ্য অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টনপূর্বক কর্মকৌশল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। তবে এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জও বটে। কারণ এমডিজির চেয়ে এক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণ প্রয়োজন হবে কয়েকগুণ, যা আমাদের মতো দেশের একার পক্ষে জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ মিলিয়ন যুব সমাজকে কাজে লাগিয়ে এসডিজির লক্ষ্য পূরণ করতে যুব উন্নয়ন খাতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। তা ছাড়া আমাদের এই যুবশক্তি শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের জন্যই কাজে লাগবে, তা নয়। বরং এসডিজি বাস্তবায়নে যেসব দেশে অভিবাসী দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন তারা আমাদের যুব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক খাতে বিনিয়োগ করে নিজ নিজ দেশের এসডিজি বাস্তবায়ন সহজেই করতে পারবে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩২ ভাগই এখন যুব (১৮-৩৫ বছর বয়সী যুবক ও যুব মহিলা)। বাংলাদেশ এখন যুব সম্পদের দিক দিয়ে এক সুবর্ণ সময় পার করছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। দেশের সবচেয়ে কর্মঠ, সৃজনশীল, উৎপাদনশীল এই মানব সম্পদই এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যুব সম্পদকে যথাযথ কাজে লাগানোর অমিত সম্ভাবনা ও সুযোগ এনে দিয়েছে। তাই ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’কে এখন আমাদের এসডিজি বাস্তবায়নের হিউম্যান ক্যাপিটাল হিসেবে কাজে লাগানোর ওপরই নির্ভর করছে সুখী, সমৃদ্ধ উন্নত বাংলাদেশ।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads