• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আইএনএফ চুক্তি

এশিয়ায় প্রসার হচ্ছে ইউরোপের উত্তেজনা

  • হাসান জাবির
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০১৮

সোভিয়েত যুগের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এসএস-৪ ও এসএস-৫। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে রুশ ভূখণ্ডের ইউরোপীয় অংশের প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা। পরে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় তৈরি হয় ওই সিরিজের মাঝারিপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এসএস-২০। ১৯৭৭ সালে রাশিয়া ওই সময়ের অত্যাধুনিক এসএস-২০ পূর্ব ইউরোপে মোতায়েন করে। এই প্রেক্ষিতে সঙ্কটাপন্ন হয় পশ্চিম ইউরোপের সামরিক নিরাপত্তা। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যুক্তরাষ্ট্র ’৭৯ সালে ব্রাসেলসে এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হয়। ইউরোপের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে ওই সমন্বিত বৈঠকে ন্যাটো জানায়, ‘ওয়ারশভুক্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে মোতায়েন করা এসএস-২০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পশ্চিম ইউরোপের নিরাপত্তাকে গুরুতর হুমকির দিকে ঠেলে দেবে।’ ফলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের মাধ্যমে ইউরোপের নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এ-সংক্রান্ত রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হয় ১৯৮১ সালের ৩০ নভেম্বর। চার মাসব্যাপী ধারাবাহিক আলোচনার পর ’৮২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা চারটি খসড়া প্রণয়ন করে। ওই ভিত্তিতেই ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত হয় পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক ‘ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস’ বা আইএনএফ ট্রিটি। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের ভূমিতে পরমাণু অস্ত্র বহনে সক্ষম ৫৫০ থেকে ১০০০ কিংবা ৫৫০০ কিমি গতির ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা স্বাধীনভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন না করা। একই সঙ্গে এ ধরনের অস্ত্রের উৎপাদন, মজুত সীমিত করা। যদিও ইউরোপের জলভাগকে এই চুক্তির আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী যুগে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত চুক্তিসমূহ, যেমন— সল্ট, এবিএম, স্টার্ট-১ ও ২ ইত্যাদির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত আইএনএফ চুক্তিটি। অতিসম্প্রতি রাশিয়ার বিরুদ্ধে শর্তভঙ্গের অভিযোগ এনে আমেরিকা একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। যদিও এ-সংক্রান্ত অন্যান্য মার্কিন কর্মকর্তাদের পরবর্তী বক্তব্য স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না আমেরিকা চুক্তি থেকে আদৌ সরে আসবে কিনা। অন্যদিকে রাশিয়া তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে চুক্তি টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে ক্রেমলিনের বক্তব্য— আইএনএফ চুক্তিটি অকার্যকর হলে নিরস্ত্রীকরণের যাবতীয় প্রক্রিয়াই বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যার প্রতিক্রিয়ায় চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা আরো তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে আইএনএফ চুক্তি বহাল না থাকলে আমেরিকা বা রাশিয়ার লাভ-ক্ষতি কী?

উভয় দেশের সংসদের বাধ্যতামূলক অনুসমর্থনের শর্ত পূরণ হওয়ার পর ১৯৮৮ সালের ১ জুন থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়। ওই চুক্তির আলোকেই ১৯৯১ সালের মধ্যে উভয় দেশ প্রায় ২ হাজার ৬৯২টি কৌশলগত মজুত অস্ত্র ধ্বংসের ব্যাপারে একমত হয়। কিন্তু হঠাৎ কংগ্রেশনাল অনুমোদন ছাড়াই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছেন। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে কি-না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমেরিকা কী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ করতে এই চুক্তি থেকে বের হতে চাইছে। এ ব্যাপারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ উত্থাপন ছাড়াও হোয়াইট হাউজ চীনের ভূমিকা নিয়ে মৃদুস্বরে আপত্তি উপস্থাপন করেছে। রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় আইএনএফ চুক্তিতে চীন সংযুক্ত নয়। ওয়াশিংটন মনে করছে, এতে করে বেইজিংয়ের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত সামরিক অভিপ্রায় আইনি সীমাবদ্ধতায় সীমিত হচ্ছে না। আইএনএফের আওতায় আমেরিকা ও রাশিয়া অস্ত্র সংবরণ করলেও এশিয়ায় চীন তার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বাড়িয়েই নিচ্ছে। যে কারণে এশিয়ার দিকে নজর দিতে যুক্তরাষ্ট্র এ কাজে উৎসাহিত হতে পারে- এমন  আভাস দিচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিশ্লেষণ। মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠেয় সাং গ্রিলা নিরাপত্তা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘চীন ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ব্যাপকভিত্তিক মোতায়েনের মাধ্যমে প্রতিবেশীদের ভয় দেখাচ্ছেন।’ তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয় চীনের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতায় ওয়াশিংটনের উদ্বেগ আছে। অন্যদিকে এশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত নয়া মার্কিন নীতির কেন্দ্রীয় লক্ষ্যই হচ্ছে নিজের আঞ্চলিক মিত্র ও বেইজিংয়ের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত দেশগুলোর নিরাপত্তা উৎকণ্ঠার অবসান করা। এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য অর্জনে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় নিজের অবস্থানগত ভারসাম্য বজায় রাখতে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

সুতরাং এশিয়ায় প্রচলিত ও অপ্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা আছে যুক্তরাষ্ট্রের। যার ক্ষেত্র তৈরিতে সহায়ক হবে আইএনএফ চুক্তি বয়কট। এই প্রক্রিয়ায় ইউরোপের পরমাণু নিরাপত্তা সংক্রান্ত সামরিক উত্তাপ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। এর মাধ্যমে এশিয়ায় চীনা ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকিতে থাকা দেশগুলোকেও একাট্টা করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপের নিরাপত্তা উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে ইইউর প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার সামরিক-অর্থনৈতিক মতবিরোধ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মার্কিন পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে নতুন মিত্র পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলো। অবশ্য পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের মধ্য দিয়েই আইএনএফ চুক্তিটির কার্যকারিতা ঝুঁকির মুখে পড়ে গত দশক থেকে।

আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার হাতে আছে এমন সব অত্যাধুনিক অস্ত্র যা দিয়ে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব। তাহলে আইএনএফ চুক্তির বাধ্যবাধকতা কেন এত জরুরি? কৌশলগত কারণে উভয় দেশের কাছেই চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি অকার্যকর হলে রাশিয়ার ঝুঁকি ও দুশ্চিন্তা বেশি, যদিও এর ফলে রাশিয়া মুক্তভাবে তার অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মস্কো কোথায় এসব অস্ত্র মোতায়েন করবে? পশ্চিম কিংবা পূর্ব ইউরোপের এমন কোনো দেশ নেই, যারা রাশিয়ার পরমাণু নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় থাকতে আগ্রহী। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপের বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। আবার রাশিয়া নিজ ভূখণ্ডের ইউরোপীয় অংশে এসব অস্ত্র মোতায়েন করে থাকতে পারে। সম্ভবত এটি ন্যাটোর দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়েছে। এক্ষেত্রে রুশ ভূখণ্ডে অস্ত্র মোতায়েনের জন্য রাশিয়া কোনো চুক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে ন্যাটো কিংবা আমেরিকা আইনি সঙ্কটের সুযোগে পূর্ব ইউরোপে আইএনএফ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত বিজিএম-১০৯জি অথবা আইবি ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করতে চাচ্ছে। রাশিয়ার জন্য এটি গুরুতর হুমকির সৃষ্টি করবে। এতে করে প্রচলিত-অপ্রচলিত যুদ্ধের সমীকরণ পাল্টে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা। রাশিয়া হয়তো পাল্টা ব্যবস্থায় সেন্ট্রাল এশিয়ায় তার সাবেক প্রজাতন্ত্রগুলোতে এসএস-২০-এর মতো অস্ত্রগুলো মোতায়েনের চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার রুশ-মার্কিন পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত ঝামেলা বৃদ্ধি পেলে সেটি হবে ইউরোপের জন্য অত্যন্ত দুঃসংবাদ। নতুন করে রুশ হুমকির মুখে থাকা ইউরোপ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে আরো বেশি মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। রাশিয়ার চিন্তার কারণটি হচ্ছে পূর্ব ইউরোপ। মস্কো জানে, এ অঞ্চলে আমেরিকা তার ওইসব ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করলে প্রচলিত যুদ্ধের সমীকরণ রাশিয়ার অনুকূলে রাখা কঠিন হবে। একই সঙ্গে এশিয়ায় চীনের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের একটি পূর্বাভাস পাওয়া গেল।

 

লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক          

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads