• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ভুল করলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০১৮

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির টেবিলে গরম চা এসেছে। প্রকৃতিও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে হৈমন্তি সাজে। মাঠের ফসলে পাক ধরেছে। চোখজুড়ানো সোনালি আভায় ভরে গেছে পল্লীবাংলার দিগন্তজোড়া মাঠ। চরাঞ্চলে কাঁচা হলুদের রঙ বিছিয়ে দিয়েছে ভুরভুর গন্ধেভরা সর্ষের অজস্র ফুল। রৌদ্রদিন লুকিয়ে ফেলেছে তার প্রখরতা। সে এখন হয়ে উঠেছে স্নিগ্ধকোমল। এ সময়ে দুয়ারে কড়া নাড়ছে গণতন্ত্রের প্রসূতি ইলেকশন। কানু বিনে কোনো গীত নেই। ইলেকশন ছাড়া এখন আর কোনো কথা নেই। হেমন্তের সকালে কিংবা বিকেলে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের মতো মানুষের মনজুড়ে এখন ভোটের উষ্ণতা। লোকের মনের রাজনৈতিক টেবিলে চা হয়তো আগেও ছিল। কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল সমঝদারের অভাবে। এই জায়গায় যারা ছিলেন, তারা রাজনীতির গরম চায়ের স্বাদে বিতৃষ্ণ, ফলে ব্যস্ত ছিলেন টা নিয়ে। এখন, বহুদিন পর সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি মনে হয় বদলাতে শুরু করেছে, এরই মধ্যে বদলে গেছে অনেকটাই। দেশে অনেক দিন রাজনীতি ছিল না। অভাজনের এই কথাটি মাটিতে পড়তে না পড়তেই কারো কারো কান গরম হয়ে যেতে পারে। তারা বলবেন, দেশে এতদিন রাজনীতি ছিল না মানে কী!  যে দেশে কবির চাইতে রাজনীতিকের সংখ্যা কম নয়, সে দেশে রাজনীতি ছিল না, বলে কোন পাগলে! আসলে, রাজনীতি ছিল কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সাচ্চা রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, সেটা নানা কারণে অনুপস্থিত ছিল, এ কথায় কারো গায়ে ফোসকা পড়ার কিছু নেই। বালুর ট্রাক দিয়ে বেগম জিয়ার বাড়ির বাইরে যাওয়ার পথ আটকে দেওয়ার মধ্যে রাজনীতি ছিল না, এমন কথা না বলাই ভালো। তারপর সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল, বিএনপির টানা অবরোধহীনতার অবরোধ, বাসে ট্রেনে আগুন, আগুনে পুড়ে অসহায় মানুষের মৃত্যু— এসবের মধ্যেও একধরনের রাজনীতি ছিল বৈকি! কিন্তু প্রথাগত গণতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে এগুলো পড়ে না। চৌদ্দ সালের ৫ জানুয়ারির ইলেকশনে খালি মাঠে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের ওয়াকওভার পেয়ে যাওয়ার আগে হেফাজতের হৈচৈ ফেলে দেওয়া ঢাকা অবরোধ এবং অচিরাৎ তা ভেস্তে যাওয়ার মধ্যেও রাজনীতি ছিল। কিন্তু সেই রাজনীতির মধ্যে সারবস্তু বলে কিছু ছিল না। আগে-পরে একাধিক জঙ্গি হামলা, মানুষ খুন করে পালিয়ে যাওয়া— এসবের কোনোটাই রাজনৈতিক ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে না। অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতি প্রেস ক্লাব আর রিপোর্টার্স ইউনিটির সেমিনার কক্ষে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল যেন বা। বিএনপির পল্টন অফিসে বসে অনবরত বাতাসে ছড়ি ঘুরিয়েছেন রিজভী আহমেদ। আর রাজনীতি ছিল টেলিভিশনের মধ্যরাতের টক শোগুলোতে। কিন্তু মাঠে ছিল একা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা। বিএনপি ছিল না। পরিস্থিতি দৃষ্টে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, বিএনপির মাঠে নামার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। ওবায়দুল কাদের সাহেবও একাধিকবার বলেছেন, বিএনপি কী আন্দোলন করবে! দশ বছরে তারা তো দশ দিনও মাঠে দাঁড়াতে পারেনি। কেন সেই দশ বা নয় বছর মাঠে দাঁড়াতে পারেনি, সেটা বিএনপিও জানে, শাসকদলও জানে। তা নিয়ে আমাদের মতো সাধারণের না ভাবাই নিরাপদ।

ইলেকশন সামনে রেখে হলেও শাসকদল ও জোটের বিপরীতে একটা ঐক্য যখন হয়ে গেছে, তখন এ নিয়ে দশজনে দশরকম কথা বলবেন, এটাই স্বভাবিক। শাসকদল ও তার মিত্ররা এই ঐক্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করছেন। দলকানা বুদ্ধিজীবীদেরও কেউ কেউ তাতে তাল দিচ্ছেন। একসময়ের অতিবিপ্লবী শাসকদলের পার্টনারদের কেউ কেউ এই ঐক্যকে ব্যাখ্যা করেন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে। তারা ড. কামালের দিকে আঙুল তোলেন। সব মিলিয়ে তারা এটাই বোঝাতে চান যে, এই

ঐক্যের কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। অতএব এদের নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা মোটেও বিচলিত নয়। কিন্তু তারা যে ভাবে ও ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তাতেই বোঝা যায় ঐক্যটা খুব গুরুত্বহীন নয়। আওয়ামী লীগ এদের ইগনোর করতে পারছে না।

এই যে একপক্ষের আরেকপক্ষকে উপেক্ষা করতে না পারা, এটাই তো গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। পক্ষে-বিপক্ষে মেঠো বক্তৃতা হবে, সক্রিয় রাজনৈতিক দল ও পক্ষগুলো নিজেদের রণকৌশল দিয়ে বাজিমাত করার চেষ্টা করবে, কথামালার বোলিং হবে, ব্যাটিং হবে। মিছিল-মিটিংয়ে সরগরম হয়ে উঠবে রাজনীতির মাঠ, চায়ের টেবিলে তর্ক হবে, ঝড় উঠবে মত ও দ্বিমতের। কিন্তু চাপাতিও বেরুবে না, বোমাবাজিও না। হিংসা ও সংঘাতের কোনো জায়গা থাকবে না। এর মধ্য দিয়ে ভোটারসাধারণ নিজেদের পছন্দটা তৈরি করে নেবেন এবং নির্ভয়ে ভোটের দিন কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রমাণ করবেন, দিনের শেষে তারাই দেশের মালিক। এটাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির আদর্শ স্কুলের কথা।

এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির এই আদর্শ অবস্থাটি কীভাবে তৈরি হবে, কে তৈরি করে দেবে? সোজা উত্তর- যারা রাজনীতি করেন এ দায়িত্ব তাদেরই। এ কথাটি যত সহজে বলা যায়, কাজ ততটা সহজ নয়, বিশেষ করে আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অবিকশিত গণতন্ত্রের দেশগুলোতে। এসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে আকাশটাকে একরকম দেখে, ক্ষমতার বাইরে থেকে আরেক রকম। এটাই বড় সমস্যা। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের ভূমিকাও এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা ছাড়া ভোটে পিপলস উইলের যথার্থ প্রতিফলনের আশা করা কঠিন।

ডিসেম্বরের তিরিশ তারিখে যে সাধারণ নির্বাচন, এটা এখন নিশ্চিতই বলা যায়। এই নির্বাচন কেমন হবে, ইলেকশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পথহারা গণতন্ত্র ঠিক রাস্তাটি খুঁজে পাবে কি-না, সেদিকে যেমন তাকিয়ে রয়েছে সাধারণ মানুষ, তেমনি বিশ্বসমাজ। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্যে তার মানবাধিকার পরিস্থিতি পরিবর্তনের এটা শেষ সুযোগ। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট বলেছে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান থেকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের বিবেচনার ব্যবধান যে রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এটা ঠিক যে, এই নির্বাচন আমাদের ঘুণেধরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসার এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। সবাই মিলে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারলে আমাদের জাতীয় জীবনে সে হবে এক ঐতিহাসিক অর্জন। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর যে জায়গাটি আজ তৈরি হয়েছে, তার পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতৃত্বের বিরাট অবদান রয়েছে। মাঠের বক্তৃতায় নেতারা যে যা-ই বলে থাকুন না কেন, কার্যক্ষেত্রে তারা ইতিবাচক ভূমিকাই রেখে যাচ্ছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন সমস্ত নিন্দা-মন্দ উপেক্ষা করে ইতিবাচক রাজনীতির পথে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের মিলিত করতে পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গণতন্ত্রের পথটাকে প্রসারিত করতে তার অবস্থান থেকে ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি বিরোধীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলোও গঠনমূলক  ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এরকম একটি পজিটিভ অবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুদিন দেখা যায়নি।

মনোনয়নপত্র সংগ্রহ, জমাদান এবং দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে, যেগুলো প্রত্যাশিত নয়। বিভিন্ন স্থানে সংঘাতের ঘটনাও ঘটেছে। এগুলোকে খুব বড় করে দেখার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক দলের নেতারাই সাংগঠনিকভাবে এসব বিচ্যুতি মেরামত করে নিতে পারবেন বলে আশা করা যায়। নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার যথার্থ প্রতিফলন যাতে ঘটে, তা নিশ্চিত করার মূল দায়িত্ব এখন ইলেকশন কমিশনের। ইসি এতদিন যা-ই করে থাকুক না কেন, এখন পরিস্থিতিদৃষ্টে মনে হচ্ছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা সবার সহয়োগিতা চাইছেন। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হচ্ছে। কমিশন তলব করলে বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই যাতে সেনাসদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেন, এরকম দূরত্বে সেনাবাহিনী অবস্থান করবে।

এক্ষেত্রে সিভিল প্রশাসন এবং থানা পুলিশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসনের মধ্যে অতিউৎসাহী কেউ কেউ থাকা অসম্ভব নয়, যারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ভণ্ডুল করতে তৎপরতা চালাতে পারেন। তাদের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। আর যারা পক্ষপাতিত্ব করতে চান, তাদেরও মনে রাখা দরকার, তারা পাবলিক সার্ভেন্ট, জনগণের সেবক। তারা কোনো দলের কর্মী বা কর্মচারী নন। সমতল মাঠ নষ্ট করে স্বাধীনভাবে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের পথ কণ্টকিত করা হলে আখেরে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads