• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

উন্নয়নের বারো আনাই দুর্নীতির পকেটে

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২১ নভেম্বর ২০১৮

দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে গোটা বাংলাদেশ। এটা নতুন খবর নয়। অফিসের কেরানি থেকে বিগ বস, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, ওয়াসা, ভূমি অফিস থেকে শুরু করে সব দফতর, অধিদফতর, সচিবালয় থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিল পর্যন্ত দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সব পেশার মানুষ। তারপরও কি সৎ মানুষ নেই! সংখ্যাধিক্যে সৎ-নিষ্ঠাবান মানুষই বেশি হওয়ার কথা। প্রশ্ন হলো, তারপরও দুর্নীতির জয় হয় কীভাবে। কী কারণে অসৎ, দুর্নীতিবাজদের দাপটে তারা চিরকাল কোণঠাসা?

বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, দুর্নীতির ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে জনগণ উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি সুফল ভোগ করতে পারে না। আর এর জন্য দায়ী আমাদের নোংরা রাজনীতি। ভাবা যায়, একটি দেশে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে যথেচ্ছভাবে অর্থ লুটপাট হয়! ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে টাকা ফেরত না দেওয়াটা একটা দম্ভের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাদ থাক সে কথা। দুর্নীতি আর লুটেরা বাণিজ্যের মাধ্যমে একশ্রেণির কিছু মানুষের কাছে চলে গেছে সব টাকা। তারা দেশে সাতপুরুষের ভোগবিলাসের অঢেল সম্পদ মজুত রেখেও যেন তৃপ্ত নন। দুর্নীতির অভিযানে ধরা খেয়ে মারা পড়ার ভয়ে বিদেশে গড়ে তুলছেন বাড়ি ও ব্যবসাপাতি।

জনশ্রুতি আছে, এদেশের উন্নয়নের বারো আনাই খেয়ে ফেলে দুর্নীতি। সরকারি কাজে দুর্নীতির ঠেলায় সুনীতি বা নীতিবানদের চরম দুর্দশার শেষ নেই। বেসরকারি খাতেও এ রোগ ছড়িয়ে গেছে ক্যানসারের মতো। বিভিন্ন সময়ে আমাদের সরকারগুলোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, স্বেচ্ছাচারিতা আর ক্ষমতার অপব্যবহার দুর্নীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে। নীতিভ্রষ্টতা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ছড়িয়ে গেছে সাধারণ মানুষের মাঝেও। এর ফলে ধ্বংস হয়েছে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলছে নিয়ম ভাঙার মহোৎসব। প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, ক্যারিবীয় দ্বীপাঞ্চলে অর্থ রেখে ব্যবসার তালিকায় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী রাজনীতিকের নাম আছে। রিপোর্টে বলা হয়, সেখানে সারা বিশ্বের ব্যবসায়ী, পুঁজিপতিরা নিজ দেশে কর ফাঁকি ও দুর্নীতির টাকা লগ্নি করছেন। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের হাজার হাজার কোটি টাকার সমান সুইস ফ্রাঁ জমা আছে। আরেক খবরে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকারের ‘মাই সেকেন্ড হোম’ প্রোগ্রামের আওতায় এ পর্যন্ত নিজ উদ্যোগে প্লট-ফ্ল্যাট কিনেছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। অভিযোগ আছে, হুন্ডির মাধ্যমে এসব ব্যক্তি হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। পাচারকারীদের তালিকায় আছেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতা, সাবেক আমলা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। হায়রে টাকা! আমার দেশের মানুষ একবেলা খাবার জোগাড় করতে কতই না পরিশ্রম করে। কত ধরনের কাজ করে। এই দেশেরই কারো কারো টাকার পাহাড় দেখে মনে হয় টাকার কোনো মা-বাপ নেই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলছেন, টাকার মালিকদের খুঁজে বের করা হবে এবং আইনের আওতায় আনা হবে। আদৌ এটা সম্ভব হবে কিনা আল্লাহ-মালুম। অনেকের মতে, দুর্নীতির জন্য ৯০ ভাগ দায়ী রাজনীতিবিদরা। নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রবণতাই দুর্নীতির অন্যতম কারণ। সহসা প্রশ্ন আসে, দেশ চালান রাজনীতিবিদরা। তারাই যদি দুর্নীতিবাজ হন, তাহলে কী করে দুর্নীতি কমানো সম্ভব-সে ভাবনাটি আসলে কার? বলা হয়ে থাকে, সরকারি চাকুরেদের জন্য ভালো বেতন দিলে দুর্নীতি কমবে। কিন্তু স্বাধীনতার পরে দেশে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে চলতি দশকে। কথা হচ্ছে, তারপরও কেন দুর্নীতি কমছে না। দুর্নীতি কমানোর সঠিক উপায়টি আসলে কী?

মানুষের মাঝে আদর্শিক চেতনার উন্মেষ না ঘটলে, সততার মূল্যায়ন না হলে, অসৎ ব্যক্তি শাস্তির আওতায় না এলে দুর্নীতি আদৌ কি কমানো সম্ভব- সে প্রশ্নটি থেকেই যায়। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় স্বল্পোন্নত  দেশগুলোতে সরকারি চাকুরেদের কম বেতন ও দুর্নীতির মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ার ফলাফল কিন্তু মোটেও ভালো নয়। তাহলে কী করলে দুর্নীতি কমবে, সে ভাবনা কি ভাবনাতেই থেকে যাবে! বিভিন্ন তথ্য-মতামত পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি যোগাযোগ যত কমানো যাবে, দুর্নীতি কমানো ততই সম্ভব হবে। তাহলে কীভাবে কাজ হবে- সে প্রশ্ন সবার মনেই হয়তোবা উঁকিঝুঁকি মারছে। এটাও অসম্ভব কি? সরকারি সব কাজে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকারি কেনাকাটায় অনলাইনের ব্যবহার দুর্নীতির সুযোগ কমাবে বলেও অনেকের অভিমত। আবার কারো কারো মতে, লালফিতার দৌরাত্ম্য কমাতে পারলে দুর্নীতি কমতে পারে।

মোদ্দা কথা হলো, দুর্নীতি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে আমাদের কিছু করা দরকার। কারণ এই দুর্নীতি আর সামাজিক অবক্ষয়ই বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত এত টাকার কাহিনী থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন উন্নয়নশীল হয়ে পড়ে থাকবে। এসব টাকা ব্যবহার করা গেলে ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। তার আগেই বাংলাদেশ আধুনিক উন্নত দেশের তালিকায় ঠাঁই করে নিতে পারবে। কথা হলো, কোন সরকার, কীভাবে এই বিশাল দুর্নীতির টাকা বা কালো টাকা আর পাচার হওয়া টাকার ব্যবহার করতে পারবে? আদৌ কি পারবে? দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন— ৫০০ জন দুর্নীতিবাজকে জেলে পুরতে পারলে নিজেকে সফল ভাবতাম। প্রতিবছর অন্তত ১০০ জন দুর্নীতিবাজকে সাজা দেওয়া গেলে দুর্নীতি বন্ধে সমাজে বড় ধরনের প্রভাব পড়ত। আচ্ছা, দুদক তো পারত বছরে ১০০ জন দুর্নীতিবাজের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে! কেন হয় না, কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছেন না। আদর্শের রাজনীতি যতদিন প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততদিন বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি থামানো যাবে না। আর দুর্নীতি না কমলে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং উন্নয়নের গতি বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই দেশের জনগণ এখন অপেক্ষায় আছে- আসছে সংসদ নির্বাচনে কারা জয়ী হয়ে আসবে, কারা এসে এই দুর্নীতির দুষ্টচক্রকে থামাবে তা দেখার জন্য।

 

লেখক : সাংবাদিক ও উন্নয়ন গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads