• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রসঙ্গে

  • আজহারুল আজাদ জুয়েল
  • প্রকাশিত ২৮ নভেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশে সমতল ভূমি বৈশিষ্ট্যের উত্তরাঞ্চলকে বলা যেতে পারে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীসমৃদ্ধ একটি অনন্য এলাকা। মূল জনগোষ্ঠী বাঙালির পাশাপাশি সাঁওতাল, উঁড়াও, মুন্ডা, পাহাড়ি, মুশোহর, কড়া, নুনিয়া, তুরি, তেলি, তাঁতি, রাজওয়ার, মালে, মাহলে, মাহাতো, কুরমি, কোল, কোডাসহ বহুসংখ্যক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে রাজশাহী-রংপুর বিভাগের এই সমতল ভূমি অঞ্চলীয় ১৬ জেলায়। এ ছাড়া রয়েছে বিপুলসংখ্যক দলিত মানুষ। যাদের প্রায় সবাই শিক্ষা, সেবা, সুবিধাপ্রাপ্তির দিক থেকে মূলধারার জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে আছেন আকাশ-পাতাল ব্যবধানে। হরিজন, ডোম, মুচি, জেলে, বেদে এই ধারারই জনগোষ্ঠী, যারা নানান কুসংস্কারের শিকার হয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছেন এবং নিজেদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকছেন।

সরকার পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে সমান্তরাল ধারায় তুলে আনতে চায়। মূলধারার জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি থেকে দলিত ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীও যেন প্রকৃত মানুষের মর্যাদায় বেঁচে থাকতে পারে, সুস্থ-সুন্দর ও মর্যাদার সঙ্গে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পারে এবং সর্বক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে সেরকম প্রচেষ্টা রয়েছে সরকারের। সেই লক্ষ্যে রয়েছে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থাও কাজ করছে তাদের সমান্তরাল ধারায় তুলে আনার জন্য।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোরও নানান উদ্যোগ আছে দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য। কিন্তু যাদের জন্য এসব আয়োজন, তারা নিজেরাই তা ভালোমতো জানেন না। তারা বোঝেন না সরকারের কাছে তারা কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন? যে সুবিধাগুলো পেতে পারেন সেগুলো তারা কীভাবেই বা পাবেন? কোথায় গেলে পাবেন? যেহেতু তারা বিষয়গুলো ভালোভাবে জানেন না ও বোঝেন না, ফলে তারা তা আদায় করতে পারছেন না। সরকারের সেবা খাতগুলো সম্পর্কে অজ্ঞতাজনিত কারণে তারা সেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকছেন। এর অবসানের জন্য গত অক্টোবর মাসে একটি তথ্যপুস্তিকা প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা এনএনএমসি-নেটওয়ার্ক ফর নন-মেইনস্ট্রিমড মার্জিনালাইড কমিউনিটি। পুস্তিকাটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমতলের আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি ও বেসরকারি সেবা তথ্যপুস্তিকা’।

১৫ নভেম্বর ২০১৮ ঢাকার ছায়ানটে তথ্যপুস্তিকাটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয় আমারও। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিললার রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে পুস্তিকাটির মোড়ক উন্মোচন করেন। এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক, নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবির, হেকস/ইপারের কান্ট্রি ডিরেক্টর অনিক আসাদ, এনএনএমসি’র চেয়ারম্যান ড. মুহম্মদ শহীদ উজজামান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক বিমল চন্দ্র রাজোয়ারসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন এই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে। একই অনুষ্ঠানে সমতলের আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য রেখে ‘বাঁচার মতো বাঁচতে চাই আমার অধিকার আমি চাই’ শীর্ষক একটি কৌশলপত্রের প্রকাশ করা হয়। ওই কৌশলপত্র সামনে রেখে ২০২১ সাল পর্যন্ত এনএনএমসি কার্যক্রম পরিচালনা করবে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের দলিত এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে।

তথ্যপুস্তিকায় সরকারি সেবাপ্রাপ্তির বিভিন্ন খাত, সেবাপ্রাপ্তির উপায় ও পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। পুস্তিকার তথ্যগুলো শুধু এনএনএমসি’র জন্য নয়, রংপুর-রাজশাহী বিভাগে দলিত ও সমতলের আদিবাসীদের কল্যাণে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের জন্য সহায়ক হবে। পুস্তিকাটির শুরুতে দলিত ও সমতলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারের আইনগত ভিত্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক নথি, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের গৃহীত নীতিমালা তুলে ধরা হয়েছে; যাতে করে আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষ সহজেই বুঝতে পারেন রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে কী কী অধিকার তারা পেতে পারেন, তাদের অধিকার সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কী ভাবা হয়। তারা কতখানি অধিকারপ্রাপ্তির অধিকার রাখেন। পুস্তিকার আরেক সূচিতে রাষ্ট্র প্রণীত দেশীয় নীতি-আইন-কর্মপরিকল্পনা, সমতলের আদিবাসীর জন্য গৃহীত কর্মসূচি-বাস্তবায়ন নীতি ও পরিকল্পনা, দলিত জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহীত কর্মসূচি-বাস্তবায়ন নীতি ও পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এখান থেকেও আদিবাসী ও দলিত জনগণ তাদের সম্পর্কে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কর্তব্য, অঙ্গীকার সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের গৃহীত কর্মসূচির সুফল পেতে পারেন।

জনকল্যাণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বহুমুখী কর্মসূচি আছে, যার সবগুলোতেই সমতলের আদিবাসী ও দলিত মানুষও সুবিধাপ্রাপ্তির অধিকার রাখেন। কিন্তু সচেতনতার অভাবে সেসব অধিকারের কোনো খবরই তারা জানেন না। শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পেশাগত উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নয়ন, নিজেদের ঘরবাড়ির উন্নয়নসহ সবকিছুতেই আদিবাসী ও দলিতদের জন্য সরকারের বরাদ্দ আছে। তথ্যপুস্তিকার মধ্যে অধিকার, মর্যাদা, সুবিধা ও সুযোগ কার মাধ্যমে, কী পদ্ধতিতে অর্জন করা সম্ভব হবে সেই উপায়ের কথা বলা আছে।

 

সরকার এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকার, সুযোগ, সুবিধাদি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ইউএনও এবং সমাজসেবা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ও যুব অফিসের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে সরকারি সুবিধা, বরাদ্দ পাওয়ার জন্য। মূলত সেই কৌশল, পদ্ধতি, উপায় জানিয়ে দিতেই দলিত ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের অধিকার সমুন্নতকরণ ও সুরক্ষার তথ্যপুস্তিকা ও কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে এনএনএমসি। এগুলো প্রকাশের তিনটি উদ্দেশ্য আছে এনএনএমসি’র। প্রথমত স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দলিত ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, রাষ্ট্রীয় সেবাদাতা, মূলধারার মানুষ ও সমমনা নেটওয়ার্কের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। দ্বিতীয়ত দলিত ও সমতলের আদিবাসী ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা। তৃতীয়ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা, অ্যাডভোকেসি কৌশল প্রতিষ্ঠা করা।

উত্তরবঙ্গ বা রংপুর-রাজশাহী বিভাগে ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ১৬ লাখ মানুষ বসবাস করে। এ ছাড়া আছে হরিজন, ডোম, মুচি, বেদেসহ বিপুলসংখ্যক দলিত মানুষ। এই বিপুল মানুষকে পেছনে রেখে বৃহৎ জনগোষ্ঠী যতই এগিয়ে যাক না কেন, সেটা কখনোই টেকসই হবে না। টেকসই হতে হলে সবাইকে নিয়ে হতে হবে।

যে তথ্যপুস্তিকা এবং কৌশলপত্র নিয়ে এনএনএমসি কাজ শুরু করতে যাচ্ছে, সেটা একটা কার্যকর উদ্যোগ হবে বলে আমার ধারণা। পিছিয়েপড়া জনগণ যখন নিজেই নিজের অধিকার বুঝবে, তখন তাকে কেউ আটকিয়ে রাখতে কিংবা পেছনে ফেলে রাখতে পারবে না।

 

লেখক : সাংবাদিক

ধ.ধুধফলববিষ—মসধরষ.পড়স

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads