• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
এক আতঙ্কের নাম বিগো লাইভ

লোগো বিগো

মতামত

এক আতঙ্কের নাম বিগো লাইভ

  • মো. মাঈন উদ্দিন
  • প্রকাশিত ২৯ নভেম্বর ২০১৮

বর্তমান যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। বর্তমান যুগ তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ যেন যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে স্মার্টফোনে মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন জন নানা ধরনের অ্যাপস, সফটওয়্যার ও  মেকানিজম ব্যবহার করছেন। সব বয়সী মানুষ যেমন এসব মেকানিজমে আকৃষ্ট হচ্ছেন, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণই নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সমাজকে। বিশেষ করে তরুণদের।

বাংলাদেশে বেশকিছু জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ও অ্যাপস রয়েছে। জনপ্রিয় বহু ওয়েবসাইটের মধ্যে দু-তিনটি হলো পর্নো (অশ্লীল) সাইট। সরকার কয়েক দফা এই সাইটগুলো বন্ধের চেষ্টা করে। কিন্তু কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর নিজস্ব আইটি বিশেষজ্ঞ দিয়ে সেগুলো ফের সচল করা হয়।

সারা বিশ্বে জনপ্রিয় অ্যাপসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক,  ফেসবুক লাইট ও স্ন্যাপচ্যাট। এগুলোর মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব অ্যাপস দিয়ে ছবি, ভিডিও, স্টিকার, অডিও ফাইল, ভয়েস ও ভিডিও কল আদান-প্রদান করা যায়।

বাংলাদেশে ব্যবহূত অ্যাপসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। তবে ‘বিগো লাইভ’ নামে নতুন একটি অ্যাপস দেশের তরুণ সমাজের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ লাইভস্ট্রিমিং কমিউনিটির এ অ্যাপসটি বতর্মানে তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক, বিবাহিত, এমনকি প্রবাসীরাও বেশ ব্যবহার করছেন। দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ায় দাম্পত্য জীবনে সুখী নন, বিশেষ করে স্ত্রী-সন্তান রেখে দীর্ঘদিন বাইরে থাকা প্রবাসীদের টার্গেট করে একশ্রেণির অসাধু চক্র এর মাধ্যমে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। কথিত মনোরঞ্জনের নামে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বিশেষজ্ঞরা এই অ্যাপসটি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে পাঁচশ বিবাহিত-অবিবাহিত তরুণী, মধ্যবয়স্ক নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের অ্যাকাউন্ট রয়েছে।  সেখান থেকে লাইভে গিয়ে অনলাইনে থাকা সঙ্গীদের সঙ্গে সরাসরি ভয়েস ও ভিডিও চ্যাটে তারা কথা বলেন। তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের পর প্রাইভেট রুমে ডেকে দাবি করা হয় অর্থ।

অ্যাপসটির কমপক্ষে ১০০টি চ্যাটরুমের চ্যাট পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ তরুণী, বিশেষ করে মধ্যবয়সী নারী প্রাইভেটভাবে চ্যাট করার জন্য প্রবাসী ও বিবাহিত পুরুষদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। প্রতিটি চ্যাটরুমেই বিভিন্ন বয়সী পুরুষরা অবাধে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন।

সমাজবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম্পত্য জীবনে হতাশা আর অশান্তিতে থাকা পুরুষদের ফাঁদে ফেলেই সবর্নাশ ঘটাচ্ছে বিগো লাইভ। দীর্ঘদিন স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের টার্গেট করেও জনপ্রিয় করে তোলা হচ্ছে অ্যাপসটি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নেন একজন সাংবাদিক। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনাকে আমরা বলি অনলাইন ভিকটিমাইজেশন। এখানে একজন তরুণী বা নারী যেভাবে অন্যের সঙ্গে কথা বলেন তা আমাদের সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে কোনোভাবেই যায় না। এসব সাইট ও অ্যাপস চলতে থাকলে যুবসমাজের সামাজিক পরিচ্ছন্নতা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ব্যাহত হবে। ফলাফল হিসেবে সামাজিক সম্মানহানির ঘটনা ঘটবে। ধর্ষণ, ইভটিজিং বাড়বে।’

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ) এক জরিপে উঠে এসেছে, ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সের শতকরা ১২ দশমিক ৭৭ জন সাইবার অপরাধে বেশি আক্রান্ত হন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৭ শতাংশ সামাজিক ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য আইনের আশ্রয় নেন না। তবে বিগো লাইভের শিকার মধ্যবয়সী আর প্রবাসীরা কেন? এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে ঘণ্টায় একটি তালাক হচ্ছে। এর মানে পরিবারগুলোতে একধরনের ফ্রাসটেশন ও বোঝাপড়ার অভাব আছে। এ কারণে দম্পতিদের মধ্যে একটা গ্যাপ তৈরি হয়। গ্যাপ হলেই পার্টনাররা (দম্পতি) অন্য অ্যাঙ্গেলে সার্চ করা শুরু করেন। তখন তারা এসব অ্যাপস বা সাইটে নক করেন।

এছাড়া বিবাহিত ও বয়স্ক লোকজনকে কনভিন্স করা খুবই সহজ। এসব অ্যাপসে টাকার বিনিময়ে কথা ও ভিডিও চ্যাট করা যায়। অধিকাংশ তরুণ ও শিক্ষার্থীদের কাছে টাকা থাকে না। কিন্তু বয়স্কদের আর্থিক কোনো সমস্যা থাকে না, সে তখন সঙ্গী খোঁজে। উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে, যদি এটা আরো ছড়িয়ে পড়ে তখন আরো বেশি সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেবে।

‘এই লাইভের কারণে সামাজিক সঙ্কট তৈরি হতে পারে। ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো ব্যক্তি যদি প্রাইভেট চ্যাটের জন্য কাউকে টাকা পাঠান, তিনি যদি ওই ব্যক্তির পরিবার কিংবা কর্মস্থলে এসব ফাঁস করে দেন তাহলে সামাজিকভাবে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তার চাকরি চলে যেতে পারে, স্ত্রীও চলে যেতে পারে। সরকারের আইসিটি বিভাগের এ বিষয়ে নজরদারি থাকা উচিত।

সাইবার বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ ধরনের অ্যাপস ও ওয়েবসাইট ব্যবহারে প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং অপহরণের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এর প্রতিকার হিসেবে অনলাইনে ডেটিং বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া অনলাইনে পরিচয় হওয়া কারো সঙ্গে দেখা না করাই ভালো। দেখা করলে পাবলিক প্লেসে করতে হবে।

বাংলাদেশে ট্রেন্ডিং (সম্প্রতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে) অ্যাপসগুলোর মধ্যে লুডো স্টার, আলিএক্সপ্রেস, টেম্পল রান-২, লুডু কিং, সাবওয়ে সার্ফার, ফিফা ফ্রি কিক উল্লেখযোগ্য। এই গেমগুলোর মধ্যে ৩০ সেকেন্ডের জন্য বিগো লাইভের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে গেমে অতিরিক্ত কয়েন পাওয়া যায়। এ কারণে অনেকে না চাইলেও বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে বাধ্য হন। এই বিজ্ঞাপনে ভুলেও যদি কারো চাপ পড়ে, তখনই তা ডাউনলোড হয়ে যাবে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি ওয়েবসাইট বিগো লাইভ থেকে অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জনের নানা কৌশল জানিয়ে দিচ্ছে। এ কারণে হতাশা ও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা থেকে অনেকেই বিগোতে আগ্রহী হচ্ছেন।

বিটিআরসি যদিও বলেন, ‘এ ধরনের অ্যাপসে আমাদের নজরদারি রয়েছে। এমন অ্যাপস পেলেই আমরা তা খতিয়ে দেখি।’ তারপরেও আমরা বলব, এ বিষয়ে সরকারের আরো নজরদারি প্রয়োজন। বিগোর ভয়াল থাবা থেকে তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়সীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য বাসায় বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের বেশি বেশি সময় দেওয়া। যেসব পরিবারে বাবা-মা উভয়ই চাকরিজীবী, সেসব পরিবারে এগুলোর প্রভাব বেশি হতে পারে। পাশাপাশি পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকে, ফ্যামিলি টেনশন থাকে- এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা না করলে পার্টনার অন্য সুযোগগুলো সার্চ করবেই। তাই আমাদের সবার উচিত সংসার জীবনে আবদ্ধ হওয়ার পর পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে পরিবারের সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া।

 

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads