• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

নির্বাচনী রাজনীতি ও বাংলার কৃষক

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ২৯ নভেম্বর ২০১৮

আবারো আন্দোলনে নেমেছেন মহারাষ্ট্রের কৃষকসমাজ। রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কৃষক মিছিল করে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সমবেত হয়েছেন দক্ষিণ মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানে। তাদের এক নম্বর দাবি কৃষিঋণ মওকুফ। এ ছাড়া তারা চান চাষবাসের অনুকূল পরিবেশ এবং শস্যের ন্যায্যমূল্য। আম আদমি পার্টিসহ প্রায় সব আঞ্চলিক দলেরই সমর্থন রয়েছে এই কৃষক আন্দোলনের প্রতি। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার উত্তরাঞ্চলের এই কৃষক অসন্তোষ নিয়ে বিব্রত। দু-এক মাসের মধ্যেই কয়েকটি রাজ্যে অনুষ্ঠিত হবে বিধানসভার নির্বাচন। সামনের বছর জাতীয় নির্বাচন। ভারতের রাজনীতিতে কৃষকসমাজের ভূমিকাটি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। দুই হাজার চৌদ্দ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতের প্রান্তিক চাষিদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেন নরেন্দ্র মোদি। তারা মোদিকে নিজেদের কাছের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন। মোদি সরকার কৃষকদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগীও বটে। তা সত্ত্বেও কয়েক মাস ধরে মহারাষ্ট্রের কৃষকরা নানা কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করে চলেছেন। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে এবং আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনে এর কোনোই প্রভাব পড়বে না- এমনটি বলা যায় না। ভারতের রাজনীতিতে চাষবাস করা জনসমাজের কণ্ঠ মোটেও অনুচ্চ নয়। পক্ষান্তরে ভারতের প্রতিবেশী আমাদের এই বাংলাদেশের রাজনীতিতে কৃষকসমাজের কোনো ভূমিকা আছে বলে মনে হয় না। তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার কোনো দায় যেন আমাদের রাজনৈতিক সমাজের নেই। উল্টো আমরা চাষিদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাই। শাকে-সবজিতে কীটনাশকের আধিক্য কেন, আমে কেন ফরমালিন, ফলের গাছে কীটনাশক দিয়ে বিষাক্ত বানানো হয় কেন- সব দায় চাষিকুলের। কিন্তু কৃষককে ফাঁদে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেই কথাটা কেউ বলেন না।

দেশজুড়ে এখন বইছে নির্বাচনী হাওয়া। দু-একদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো  নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করবে। অনুমান করি, এসব ইশতেহারে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার থাকবে। নারীর অধিকার রক্ষার কথা থাকবে, বেকার সমস্যার সমাধান ও কর্মসংস্থানের কথা থাকবে, শ্রমিকের অধিকারের কথা থাকবে, পরিবেশ রক্ষার কথা থাকবে। হয়তো কৃষকের স্বার্থরক্ষার বিষয়েও দু-চারটি বাণী লিপিবদ্ধ থাকবে। কিন্তু কৃষকের সমস্যাগুলো খুব গুরুত্ব পাবে, এমনটি আশা করা যায় না। সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হলে চাষবাসের মূলগত সমস্যাগুলো কী এবং  কীভাবে তৈরি হলো, এসব সমস্যার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সে সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা দরকার। সেটা আমাদের রাজনীতিতে এখন আর নেই। সত্যি কথা বলতে কী, সে অবকাশও নেই। সমাজ ও রাজনীতিতে এতসব আলগা সঙ্কট তৈরি করা হয়েছে যে, সুনির্দিষ্ট করে কৃষি ও কৃষকের সমস্যার দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই কারো। ফলে নীরবে নিভৃতে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক এক ভয়ানক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হচ্ছে। কৃষি থেকে কৃষক উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে ফসলের জমি বর্গা কিংবা বন্ধক দিয়ে অথবা পতিত ফেলে রেখে প্রান্তিক কৃষক বাসে ট্রেনে বা লঞ্চে করে চলে আসছে শহরে। সে নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। রিকশাপোলার হচ্ছে। আলোবাতাসহীন বস্তিতে, মেসে, গ্যারেজে পাতা চৌকিতে ঘুমোচ্ছে। বউকেও নিয়ে এসেছে অনেকে। সে গার্মেন্টে কাজ করছে। ছেলেও রিকশাওয়ালা হবে। তৈরি হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের দুয়েকজন যাও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাস দিয়েছে, তারা চাকরি খুঁজছে। গার্মেন্টে ঢুকছে। যারা গ্রামে থাকছে, তারা চাষবাস ফেলে রাজনৈতিক নেতাদের হয়ে গুন্ডামি করছে। চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং বড় নেতার পেছনে ঘুরে কী করে চাঁদাবাজি করা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির টাকার ভাগ পাওয়া যায়, বালুর মহাল , জলমহাল, গুদারাঘাটের ইজারা নিয়ে কী করে মানুষ ঠকানো যায়, সেসবের তালিম নিচ্ছে। কেউ ইয়াবার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। এসব করে তারা ভালোই আছে। কখনো কখনো বিপদে পড়ছে। মাদক ব্যবসায়ীর খাতায় নাম লিখিয়ে মারাও যাচ্ছে। এসব আউল-ফাউল করে, বিপথে পরিচালিত হয়ে আপাতদৃষ্টিতে কেউ কেউ ভালো থাকলেও ভেতরে ভেতরে যে সব ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, সে খবর নেই।

এই পরিস্থিতি কেন কীভাবে তৈরি হলো, সে এক জরুরি প্রশ্ন। স্বীকার্য এর পশ্চাতে আর্থ-সামাজিক নানা কারণ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের পুরুষানুক্রমিক কৃষি ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের নোংরা নাক গলিয়ে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, সেও এর জন্য কম দায়ী নয়। কৃষকের বীজের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে সুকৌশলে। চাষাবাদ করা হয়েছে ব্যয়বহুল। কৃষি খাতে সহায়তার নামে খারাপ ব্যবসার পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। ষাটের দশকে গ্রো মোর ফুড স্লোগান দিয়ে এদেশে সেচনির্ভর ইরি ধানের আবাদ শুরু হয়। তখন কৃষক সমিতির মাধ্যমে গ্রামে স্কিম করে সরকার পাওয়ার পাম্প সরবরাহ করত নামমাত্র ভাড়ায়। পাওয়ার পাম্প চালানোর জন্য ডিজেলও সরবরাহ করা হতো বিনেপয়সায় অথবা খুব কম দামে। ইরি ধানের জন্য রাসায়নিক সার অত্যাবশ্যকীয়। সেই সারও বিএডিসির মাধ্যমে সস্তায় চাষিদের দেওয়া হতো। কীটনাশক পাওয়া যেত মাগনায়। জমিতে কীটনাশক ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগের আলাদা কর্মচারী ছিল, যারা গ্রামে গিয়ে ধানের খেতে পরিমাণমতো পেস্টিসাইড স্প্রে করে আসত। স্প্রে মেশিনটাও ছিল সরকারি। এই ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। ইরির পরে এলো ব্রি। ফিলিপাইনের রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইরির অনুকরণে বাংলাদেশের কৃষিবিদরা উদ্ভাবন করলেন ব্রি ধান। ব্রি ধানের বহু ভ্যারাইটি ইতোমধ্যে আমাদের কৃষিবিদরা উদ্ভাবন করেছেন। ব্রি ধানের সঙ্গে বাংলাদেশের দেশি জাতের ধানের মিল রয়েছে স্বাদ ও গন্ধে। ইরির চাল মোটা। কিন্তু ব্রি ধানের চাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুস্বাদু এবং সরু। তবে এ ধানটিও সেচনির্ভর। আজকাল বোরো এবং আমন উভয় মৌসুমেই ব্রি ধানের চাষ হয়ে থাকে। ব্রি ধানকে বলা হয় উচ্চফলনশীল জাত। উচ্চফলনশীল হলেও এই ধানের বীজ বাছাই করে কৃষক নিজেই সংরক্ষণ করতে পারত।

নব্বই দশকে দেশে এলো হাইব্রিড। হাইব্রিড বন্ধ্যা। এই ধানের বীজ চাষি সংরক্ষণ করতে পারেন না। বছর বছর এই বীজ বিএডিসি, ডিলার বা অন্য বীজ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে হয়। এখন হাইব্রিড ছাড়া কোনো ফুল ফল শস্য- কিচ্ছু নেই। লাউয়ের চারটি চারা তুলতে চাইলেও বীজ কিনতে হবে অথবা নার্সারি থেকে চারা কিনে আনতে হবে। লাউয়ের মাচায় লাউ ফলাতে হলে তিন-চার রকমের সার ও কীটনাশক প্রয়োগ অত্যাশ্যকীয়। বড় বড় দেশি গেন্দাফুল— সেও হারিয়ে গেছে। শহরের বাগানে, আইল্যান্ডে ছোট ছোট গাছে অনেক গেন্দাফুল ফুটে থাকে। দেখতে কী সুন্দর! এগুলোর একটাও দেশি নয়। সব হাইব্রিড। এই ফুল থেকে বীজ হয় না। আরেক বছর আবার চড়া দামে বীজ বা চারা কিনতে হবে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এই ফুলের চাষ করতে হলে অনেক টাকার মামলা। ছোট চাষির সাধ্যে তা কুলোয় নয়। হাইব্রিডের জ্বর নামতে না নামতেই এসে গেছে জিএম ফুড- জেনেটিক্যালি মডিফাইড বীজ। এও বন্ধ্যা। চাষির সাধ্য কী বীজ সংরক্ষণ করে! কোনটা জিএম আর কোনটা হাইব্রিড, সেও চিনে নেওয়া সাধারণের কর্ম নয়। জিএম ফুড নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকেই বলেন, এই শস্য মানবদেহের জন্য এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ইউরোপ আমেরিকায় জিএম ক্রপ আবাদের অনুমোদন দেওয়া হলেও প্রতিটি শস্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর। সে সব দেশে এই বীজ অবলীলায় উৎপাদন পর্যায়ে যেতে পারে না। ভারতে জিএম ফুড নিয়ে এখনো অনেক বিতর্ক আছে। বিটি বেগুন নিয়ে তো নব্বইয়ের দশকে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। কৃষক আন্দোলনের এটাও একটা ইস্যু। আর আমাদের দেশে কৃষিমন্ত্রী নিজেও জিএম ফুডের বড় অ্যাডভোকেট।     

হাইব্রিড ও জিএম ক্রপের সুবাদে বাংলাদেশে বিঘাপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে এ কথা সত্য। কিন্তু দিনের শেষে প্রান্তিক চাষি কতটা লাভবান হচ্ছেন, সেটাই প্রশ্ন। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন ও ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণে। দিনকে দিন সারের রিকয়ারমেন্ট বেড়েই চলেছে। কারণ জমির প্রকৃতিগত উর্বরতা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না।

দেশে এখন রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় পাঁচ মিলিয়ন টন। অন্যদিকে আমাদের সার উৎপাদনের নিজস্ব কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা কেবলই হ্রাস পেয়ে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় এক মিলিয়ন টন সার উৎপাদন হয় কি-না সন্দেহ। রাসায়নিক সার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন গ্যাস। গ্যাসের অভাবে সার উৎপাদন ব্যাহত হয়। সার উৎপাদন না করে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে প্রাইভেট কারওয়ালাদের। পুরনো কারখানাগুলোর সংস্কার-মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। কর্তারা যেন বসেই আছেন এসব কারখানার স্বাভাবিক মৃত্যুর অপেক্ষায়। এটা হলে তাদের পোয়াবারো হবে। বিদেশ থেকে চড়াদামে রাসায়নিক সার আমদানি করে ভর্তুকির নামে শতসহস্র কোটি টাকা মেরে খাওয়ার ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হবে। কৃষি ও কৃষকের বারোটা বাজবে, তাতে কী আসে যায়। নতুন একদল চিন্তাবিদ গজিয়েছেন, যারা ইতোমধ্যে বলতে শুরু করেছেন, আরবানাইজেশন করতে হবে। এর সাদামাটা অর্থ হলো, কৃষি থেকে কৃষককে উচ্ছেদ করে, দেশের জমির উর্বরতা গ্রাস করে, নদী-খাল মেরে বাংলাদেশকে তারা সিটি স্টেট বানাতে চান। সেই নগরে এদেশের ৩৭ ভাগ কৃষকের এক বিরাট অংশকে তারা নাগরিক মজুর বানাতে চান। এদের ছেলেমেয়ে কেউ হবে রংবাজ দাঙ্গাবাজ, কেউ হবে পোষা গুন্ডা, জিপিএ-৫ পেয়ে জীবনে একবার হলেও কারো কারো ছবি ছাপা হবে পত্রিকায়। আবেগপ্রবণ সাবএডিটর শিরোনাম দেবেন, ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। আহ কী আনন্দ!

এই যে একটা পরিস্থিতির দিকে আমাদের গড্ডলিকাপ্রবাহে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এর কোনো প্রতিকার কি নেই গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমাজের কাছে? বাংলার কৃষি ও কৃষকের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার কোনো দায় এদেশের ‘জনবান্ধব’ জননেতাদের নেই?

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

saleheenfa@gmail.com        

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads