• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকৃতির রাজ্যে ধ্বংসের খেলা

  • নাফিউর রহমান ইমন
  • প্রকাশিত ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

সুন্দর প্রকৃতির লীলাভূমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। লতাপাতা থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় কী নেই এই সবুজ ক্যাম্পাসে? বিশ্ববিদ্যালয়ের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সৌন্দর্য। দিগন্তজোড়া কাশফুলের মাঠ, সাদা শুভ্র ফুলের মাঠ, যা কল্পনার জগৎকে জাগ্রত করে। এখানে ছোট ছোট টিলা আছে। এগুলো আকারে অনেক বড় না হলেও খুঁজে নেয়া যায় পাহাড়ি আবেশ। মেডিকেল সেন্টারের ঠিক সামনেই আছে ব্রিজ। ব্রিজের পাশে পদ্ম-লেক, হরেকরকম গাছ-গাছালি, নানা ধরনের প্রাণী, লালমাটি, উঁচু-নিচু রাস্তার কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রাজধানী বলা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে।

রবীন্দ্রনাথ নিসর্গের যে সৌন্দর্য নান্দনিকভাবে এঁকেছেন তা অতুলনীয়। এখানে উচ্ছ্বাস আছে, প্রেম আছে, আধ্যাত্মবাদ আছে, আছে অজানাকে জানার আকুতি, আছে প্যান্থেয়িজম। কিন্তু প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের ভেতরেই যে উইলিয়াম ব্লেকের ‘সিক রোজ’-এর মতো কদর্য রূপ আছে তা প্রকৃতির শূন্যতা না দেখলে বোঝা যায় না। প্রকৃতির এই শূন্যতা যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট। দূষণের ফলে প্রকৃতি হারায় তার রূপ, গন্ধ, নান্দনিকতা ও নির্মলতা। প্রকৃতির এই বিপর্যয়ের রয়েছে নানা কারণ। প্রাকৃতিক কারণও যে নেহাত কম নয় তা বিভিন্ন তথ্য দেখলেই বোঝা যায়। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই পৃথিবী মোট ১৩ বার ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে, ফের জীববৈচিত্র্যে ভরে গেছে। পৃথিবী এতবার ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে শুরু করে ভূগর্ভে প্লেটের সংঘাত— অনেক কারণেই পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে।

তবে মানবসৃষ্ট কারণ প্রকৃতি পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামক। মানুষ নির্বিচারে গাছ কেটে, আগাছা পরিষ্কারের নামে বন-জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান নষ্ট করছে। পরিবেশের এই ধ্বংসের খেলায় পিছিয়ে নেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নানান অজুহাতে কাটা হচ্ছে গাছপালা, ভরাট করা হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাশয়। সরেজমিন দেখা গেছে, বিশমাইলে দীর্ঘ একটি লেক, লেকের বিপরীত পাশে রয়েছে পুকুর, নতুন কলা ভবন ও টিচার্স ক্লাবের মাঝখানে লেক, আল বেরুনী হলের পাশে লেক, ট্রান্সপোর্টের সামনে লেক, জহির রায়হান অডিটোরিয়ামের সামনে দুটি পুকুর, সুইমিং পুলের পাশে লেক, মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের লেকে নানা রকম পট, কচুরিপানা, ঘাসে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় এসব লেক কচুরিপানায় ভরে যাওয়ায় মাছসহ নানা ধরনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তারও আগে কয়েকটি স্থানে নতুন ভবনের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম। যার জন্য কাটা হচ্ছে গাছপালা, ভরাট করা হচ্ছে জলাশয়। পরিবেশপ্রেমী বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনের ফলে আইবিএ ভবনের জন্য নির্ধারিত স্থানে অবশ্য নতুন করে গাছ লাগানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে গর্জন ও শাল গাছের ১ হাজার চারা রোপণ করা হবে।

প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের ভূমিকা যেমন ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের ভারসাম্য ও সুষম জলবায়ুর প্রয়োজনে একটি দেশের মোট আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা আবশ্যক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২০০৬ সালে চার বিলিয়ন হেক্টর (১৫ মিলিয়ন বর্গমাইল) বা বিশ্বের জমির প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকাজুড়ে অরণ্য রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৩ সালের হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১১ শতাংশ, ভারতে ২৩ দশমিক ৭, পাকিস্তানে ২, নেপালে ২৫ দশমিক ৪ এবং শ্রীলঙ্কায় ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ বনভূমি আছে। এই বনাঞ্চল অনেক প্রাণীর লালনক্ষেত্র হিসেবেও যেমন কাজ করে, তেমনি বিভিন্ন নদীনালার পথ পরিবর্তন, মাটি সংরক্ষণের মতো কাজও করে থাকে।

পৃথিবীর জীবমণ্ডলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ অরণ্য। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাতে পর্যাপ্ত বৃক্ষ থাকা খুবই প্রয়োজন। বৃক্ষহীনতার কারণে পৃথিবীর নতুন নতুন অঞ্চল মরুময় হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বনের ওপর নির্ভরশীল বিশ্বের প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানবজীবন সমস্যায় পড়তে পারে আগামী শতকের মাঝামাঝি। তিন দশমিক পাঁচ বিলিয়ন কিউবিক মিটার কাঠ ব্যবহার করে প্রতিবছর আট হাজার বর্গহেক্টর বনভূমি ধ্বংস করছে পৃথিবীর মানুষ। বনভূমি ধ্বংস হওয়ার ফলে পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিমের বহু বন্যপ্রাণী ও সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তৃত এলাকার মরুময়তা রোধে ২০ হাজার হেক্টর ভূমিতে বনায়ন-বৃক্ষায়ন করা প্রয়োজন।

মানুষ কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে (শ্বাস-প্রশ্বাসের সময়) এবং অক্সিজেন গ্রহণ করে। অন্যদিকে উদ্ভিদ অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। পৃথিবীতে বৃক্ষের পরিমাণ হ্রাস পেতে থাকলে একসময় মানুষের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। পরিবেশ ভারসাম্য হারালে আগামী পৃথিবী হুমকির সম্মুখীন হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ। তারা বলছে, দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। উদ্ভিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এ আশঙ্কায় উদ্ভিদ নিধনকে অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে তুলে ধরেন এবং বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।

প্রকৃতিকে ভালোবাসা মনের গভীর থেকে আসে। এটা চেষ্টা করে হয় না। এই প্রকৃতি যদি হারিয়ে যায়, এই গাছপালা যদি না থাকে তাহলে পরিবেশে বৈচিত্র্য থাকবে না। দিন দিন পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা এত বেড়ে চলেছে যে, তাদের খাদ্য জোগানো, ওষুধ-চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বহু কাজে আমাদের এ বৈচিত্র্য প্রয়োজন। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। প্রতিবছর প্রকৃতি সংরক্ষণে নানারকম আয়োজন করা হয় এসব সংগঠনের মাধ্যমে। তারই অংশ হিসেবে প্রজাপতি মেলা, পাখি মেলার আয়োজন হয়ে আসছে প্রতিবছর। নিজেদের স্বার্থেই সচেতন নাগরিকদের আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায়। বাসযোগ্য পৃথিবীকে সবুজ করে গড়ে তুলুন।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads