• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

সময় এখন সমঝোতার

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ০২ ডিসেম্বর ২০১৮

নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর জনমনে এক ধরনের স্বস্তি নেমে এসেছিল কিন্তু কয়েকদিন যেতেই স্বস্তি নানা শঙ্কায় পরিণত হয়। সব দল, জোট রাজনৈতিক ব্যক্তি, রাজনৈতিক পরিবার, নেতাকর্মীসহ শুভানুধ্যায়ীরা দেখে দলে দলে বিরোধী পক্ষের লোকজন শুধু নিগৃতই নয়, লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে। সরকারি দলের হাই কমান্ড থেকে কঠোর নির্দেশের পরও গৃহদাহ শুরু হয়ে যায় এবং মোহাম্মদপুরে দুই কিশোর নিহত হয়। পরে নরসিংদী। এ রকম যখন অবস্থা তখন অনেকের নাক কাটা যায়। বিরোধী পক্ষ সুবোধ বালকের মতো নয়াপল্টনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আনন্দ উল্লাসে, এক পক্ষের বদনাম হবে, অন্য পক্ষের হবে না, এ হয় না। কার প্ররোচনায় কে জানে ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ টাইপের মারদাঙ্গা হয়ে গেল। ব্যাপক হারে ধরপাকড়াও হলো। সাক্ষাৎকারসহ গণভবনের পাশের রাস্তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম হয়ে রইল। নয়াপল্টনে গোলাগুলি পর্যন্ত হয়ে গেল। রাস্তা পরিষ্কার করার জন্য।

শুধু কি তাই, হাই কমান্ডের নির্দেশ অমান্য করে শিরিন আক্তারের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবিতে ফেনী উত্তাল হয়ে ওঠে। ফেনী-১ আসনে প্রার্থী ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। কিন্তু মহাজোটে প্রার্থিতায় (পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া) নিয়ে ফেনী-১ আসনে জাসদ সধারণ সম্পাদক শিরিন আক্তার নৌকার মনোনয়ন পান। আর এতেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগের অত্র এলাকার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। তাদের দাবি মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে হবে। তারা নৌকার বদলে লগি-বৈঠা নিয়ে মিছিল মিটিং, রাস্তা অবরোধসহ জ্বালাও পোড়াও করে ফেনী-পরশুরাম সড়ক অবরোধ করে। এই তো গৃহদাহের শুরু।

এদিকে রেজা কিবরিয়া ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ আওয়ামী লীগ ছেড়ে ঐক্যফ্রন্টের গণফোরামে এসে যোগ দিয়েছেন, নির্বাচন করবেন ধানের শীষে। আগামী কিছু দিনের মধ্যে আরো কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটবে, যা নাকি দুই দলের ভেতর এখন রাজনৈতিক কৌশল বলে তারা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। নদী যদি একবার আগ্রাসী হয়, তবে ভাঙন রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়।

বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের নেতাদের এখন আশ্রয়স্থল হয়ে দেখা দিয়েছে গণফোরাম। অনেকেই আসছে, আগমীতেও আসবে। গণফোরাম এখন গতিশীল, সম্প্রসারণশীল একটি রাজনৈতিক দলের নাম।

ড. কামাল হোসেনকে এত ব্যক্তিশালী দেশপ্রেমিক হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ আর কখনো দেখেনি। তার সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের বলিষ্ঠ কণ্ঠ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সুলতান মনসুর। নির্ভীক, ভয়শূন্য নির্বাচনী উৎসব আন্দোলন এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে যা অনেকেই কল্পনা করতে পারেনি।

নির্বাচন কমিশন ভেবেছিল রুটিন ওয়ার্কের মতো নির্বাচন হয়ে যাবে। উপদ্রবহীন নির্বাচন হয়ে যাবে। কিন্তু না, বিভিন্ন দলের দাবি, আর অভিযোগের পাহাড় ক্রমেই জমে যাচ্ছে। ছক কাটা নির্বাচন করা যাবে না। এ সমস্ত কারণেই নির্বাচন এখন আর স্বস্তিদায়ক থাকছে না।

শঙ্কার কারণ তো আরো আছে। যশোরে থেকে নির্বাচনী কারণে ঢাকা এসে লাশ হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া। পাবনা বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী পিন্টু নিখোঁজ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-৪ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী জাকারিয়া পিন্টু নিখোঁজ হয়েছেন। তিনি পাবনা-ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। ঢাকার মিরপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে গুলশান যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন বলে পরিবার থেকে জানানো হয়। এই ধরনের শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গুপ্তহত্যা, অপহরণ, অন্তর্দ্বন্দ্ব, কৌশল-অপকৌশল ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভয়ভীতি জনমনে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে না পারলে সুষ্ঠু নির্বাচনী আবহাওয়া বজায় থাকবে না।

আর এ সময় মাথা গরম করে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তার খেসারত দিতে হবে। রাজনীতিতে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। রাজনীতির গুণগত মান এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হয়। রাজনীতি এখন আর কৌশল নেই, অপকৌশলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। জাতীয় পার্টি এরশাদ সাহেব বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় বার বার হসপিটালাইজড হচ্ছেন। জনমনে তা নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। নানা কারণে নেতাকর্মীরা হন্যে হয়ে রুহুল আমীন হাওলাদার আর পার্টির চেয়ারম্যানকে খুঁজছেন। পাচ্ছেন না। তাদের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকে বলা যাচ্ছে না। দশ ডিসেম্বর পর্যন্ত নানা সমীকরণে রাজনীতি, আলু-পরোটা গরম তাওয়া থেকে কে কে তুলে খেতে পারবে বোঝা যাবে। বিশেষ করে জাতীয় পার্টিতেও গৃহদাহ শুরু হবে শেষ মুহূর্তে তা ঠেকানোর জন্যও লুকোচুরি চলছে। মোদ্দাকথা এখন সবাই হিমশিম খাচ্ছেন। মহাজোট, ঐক্যজোট, নির্বাচন কমিশন তাদের দফায় দফায় মিটিং, আদেশ, নির্দেশ কিছুই আমলে আনছে না কেউ। দৃষ্টান্ত হিসেবে দু-একটি কাজ না দেখতে পারলে দক্ষ বা সফল কাউকেই এ মুহূর্তে বলা যাবে না। নির্বাচন কমিশনে পড়া অভিযোগের পাহাড় থেকে বাছাই করে দু-একটি দৃষ্টান্তমূলক অপসারণ, শাস্তির ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ব্যবস্থা নেওয়া মানে তাদের ভাবমূর্তি হয়তোবা অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে। তারা সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবেন। সবার অংশগ্রহণমূলক এই নির্বাচনে তাদের কাজের পরিধি এতই বেড়ে গেছে যে, আগের মতো রুটিন বা ছকবাঁধা কাজ আর থাকছে না।

এমনও দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে কেউ কেউ জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের মতো কাজটিও করিয়ে নিচ্ছেন। এ কাজটি অনেক আগেই করা যেত। যেমন মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী মমতাজ তার জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজের স্বামী ও শিক্ষাগত যোগ্যতা সংশোধন চেয়ে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছেন। এ আবেদন গ্রহণ করে কমিশন অনুমোদন দিয়েছেন। নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানান, তফসিল ঘোষণার পর থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন ও হস্তান্তর বন্ধ রয়েছে। তবে আইন অনুযায়ী কমিশনের অনুমোদন নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করা হয়। সংসদ সদস্য মমতাজের আবেদনটি কমিশন অনুমোদন দেয়। মমতাজের সংশোধনী ফর্মে স্বামী রমজান আলীর স্থলে এএমএম মঈন হাসান চেয়েছেন। আর শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণির জায়গায় দশম শ্রেণি চেয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। নৌকা নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদে আসতে চান।

ছোট ছোট বাড়তি এ রকম বহু কাজ এখন নির্বাচন কমিশনকে করতে হচ্ছে। বলছিলাম দলে দলে বিভিন্ন ইস্যুতে নানা অন্তর্দ্বন্দ্বে অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম করে বসছে। দলের বড় নেতা-নেত্রী বহিষ্কার, হুঙ্কার কাজে আসছে না। দলের চেইন অব কমান্ড একবার ভেঙে গেলে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। একজন সংবাদকর্মী তার পরম অর্জন মনে করেন তিনি যখন ধাপে ধাপে সম্পাদক হয়ে ওঠেন। একজন ক্যাডার সার্ভিসের পরম আরাধ্য সচিব হওয়া, একজন ব্যাংক কর্মকর্তার সাধনা থাকে এমডি হওয়া, একজন রাজনৈতিককর্মীর স্বপ্ন থাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে এমপি হয়ে সংসদে যাওয়া, মন্ত্রী হওয়া। আর সেই স্বপ্নে যদি গুড়েবালি পড়ে তখন স্বপ্নভঙ্গের কারণে কেউ কেউ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে না। আজকের ডিজিটাল যুগের রাজনৈতিক নেতারা তো কখন গরম আর কখন ঠান্ডা বলা মুশকিল। ডিজিটাল যুগ মানেই গরমের যুগ। তাই দেখি গৃহদাহ। ভাইয়ের শত্রু বিভীষণ। শত্রুময় চারদিক। চাণক্যনীতিকে হার মানায়। সময়টা ভালোর বদলে খারাপের দিকে না যায়, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের। তাদের ভুলের জন্য জনগণকে যেন আর খেসারত দিতে না হয়। সবাই যদি নিজ নিজ ঘর সামলে রাখে তবেই মঙ্গল। আনুগত্য ভালো, এর সুযোগ নেওয়া ভালো ফল বয়ে আনে না। দলে, দেশে সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর এখনই পরীক্ষার সময়। চেইন অব কমান্ড ধরে রাখা। মাথা গরম না করা। মাথা ঠান্ডা রেখে তক্কে তক্কে চলা বা সাবধানে চলা, সাবধানের মাইর নেই। নেতা ও কর্মীর সম্পর্কের পরীক্ষা এখনই। এখন গৃহদাহ নয়, সময় সমঝোতার, আলোচনার।

 

লেখক : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads