• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আছে ভাঙা শিশি...বোতল...বুদ্ধিজীবী

  • মাসুদ কামাল হিন্দোল
  • প্রকাশিত ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮

আজকের সকালটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। অন্যান্য দিনের মতো না। প্রতিদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙে কাক ও বিভিন্ন ফেরিওয়ালার সুরে এবং বেসুরের হাঁকডাক শুনে। ছাই কিনবেন ছাই, মুরগি নিবেন মুরগি বা আছেনি পুরান ভাঙা শিশি-বোতল বিক্রি ইত্যাদি আওয়াজ শুনে। আজ সে ধরনের কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। আজকের ডাকটা অন্য রকম। সে আওয়াজ আগে কখনো শুনিনি। অদ্ভুত ধরনের এক ডাক শোনা যাচ্ছে। কোথা থেকে আসছে এ আওয়াজ? আছে ভাঙা শিশি...বোতল...বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধি নেবে বুদ্ধি...। বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি। অর্জনের বুদ্ধি, বর্জনের বুদ্ধি, একদলীয় শাসনের বুদ্ধি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের বুদ্ধি। আরোও অনেক বুদ্ধি আছে। স্যাবোটাজ নাটক মঞ্চায়নের বুদ্ধি, আমলা বিদ্রোহের বুদ্ধি। গুমকে ঘুম বলে চালিয়ে দেয়ার বুদ্ধি, কিংস পার্টি গঠনের বুদ্ধি, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্রের বুদ্ধি, মুক্তবুদ্ধিকে বন্দি করার বুদ্ধি। আরও অনেক অনেক বুদ্ধি আছে আমাদের ঝুলিতে। আমরা বুদ্ধি দিতে ভালোবাসি। তাই বুদ্ধি দিতে বারবার ছুটে আসি দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে। অন্যভাবে বলা যায় নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা সরব হয়ে উঠি। শত থেকে হাজার সুশীলের তালিকায় ঢুকে যাই যাদুমন্ত্র বলে।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ  বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত থাকলেও বুদ্ধি দেয়া আমাদের হবি। বলতে পারেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। আর এই হবি থেকে নেশা। এখন বলতে পারেন লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। হরেক রকম বুদ্ধি দিয়ে থাকি। তাই লোকে বলে বুদ্ধিজীবী। কেউ বলে সুশীল সমাজ কেউবা বলে নাগরিক সমাজ। নামে কি আসে যায়। টিভি অন করলেই আমাদের দেখা যায়। পত্রিকার পাতা উল্টালেই আমাদের ছবি বা বিবৃতি থাকবেই। মানববন্ধন থেকে না-মরণ অনশন। সব কিছুতেই আমরা আছি বেশ। এই টক শোতে চেহারা দেখানো আর বিবৃতি আমাদের অন্ন বন্ত্র বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। দিচ্ছে সামাজিক মর্যাদা। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো আর পদ-পদবি-পদক। এ দেশের উদার গণতান্ত্রিক যুগে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকলেও এখন আর বুদ্ধি বিতরণে কোন বাঁধা নেই। এমনকি স্পর্শকাতর কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করলেও। বরং বলতে পারেন আমরা দেশের বুদ্ধির ঘাটতি পূরণ করছি স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মতামত দিয়ে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছি স্বপ্রণোদিত হয়ে। আমাদের ডেকে আনতে হয় না। আমরা চাইলেও বুদ্ধি দেই। না চাইলেও বুদ্ধি দেই। এমনকি জোর করেও বুদ্ধি দেই। গায়ে মানে না আপনি মোড়লের মত।

‘সুশীল সমাজ’ তথা বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সংসদে নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে বলেছেন, তারা চোখ থাকতে অন্ধ, কান থাকতে বধির। বাংলায় একটা গান আছে না (বাংলা চলচ্ছিত্রের একটি পুরনো দিনের গান) ‘হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’। ঠিক জানি না সুশীলের ব্যাখ্যাটা কী, অর্থটা কী? কোন তত্ত্বের ভিত্তিতে মানে কোন তত্ত্বে তারা এখন সুশীল-সেটাই প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, যখন তারা কোনো কিছু দেখেনও না, শোনেনও না, বোঝেনও না।

‘দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী লুটপাটের ভাগ পান বলে অভিযোগ করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, ওই বুদ্ধিজীবীরা কথিত উন্নয়নের পক্ষে কথা বলেন। বুদ্ধিজীবী সমাজের আত্নসমর্পণের কারণে দেশ আরও অধঃপতনে যাচ্ছে বলেও  মন্তব্য করেন তাঁরা। গণতান্ত্রিক জোটের মতবিনিময় সভায় নেতারা এসব কথা বলেন (দৈনিক প্রথম আলো ২৬-১- ২০১৮)’।

বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকে এক সাক্ষাৎকারে ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক আহমেদ রফিক বুদ্ধিজীবীদের সমপর্কে বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে শ্রেণিস্বার্থের প্রয়োজনে সর্বমাত্রিক প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। বুদ্ধিজীবীরা এখন আয়েশে আরামে আছেন। তাই তারা যুক্তিবাদী-মুক্তবুদ্ধির সামাজিক আন্দোলনের ঝুঁকি কাঁধে নিতে চান না। এ ছাড়া স্বার্থহানির আশঙ্কা রয়েছে।’? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘কথিত সুশীল সমাজ আদৌ সৃষ্টিশীলতার অনুকুল? গণতন্ত্রের অনুকুল। তাদের ভালো ভালো কথার ফল তো বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের জনগণের জন্য খারাপ হচ্ছে’। কবি প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন তার এক কলামে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন আমাদের দেশের ‘আত্নীয়সমাজ কবে নাগরিক সমাজ হবে।’ আহমেদ সফা বহু যুগ আগেই আমাদের সামনে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের স্বরূপ উন্মোচন করে গেছেন তাঁর ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ বইয়ে।

বিছানায় শুয়ে ভাবছি বুদ্ধিজীবীরা ফেরিওয়ালার ভূমিকায় কেন (পরজীবী বিবৃতিজীবী বুদ্ধিজীবীরা পরিণত হয়েছেন রাজনৈতিক পণ্যে)? দেশে কি বুদ্ধির চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বুদ্ধির সঙ্কট কি মহামারি আকার ধারণ করেছে। সাধারণ মানুষ কি বিচার বিবেক বিবেচনাবোধ হারিয়ে ফেলেছেন? সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারছেন না। একযোগে দেশের সব মানুষ বুদ্ধিশূন্যতায় ভুগছে? তাহলে এই তথাকথিত বুদ্ধি কার জন্য? কিসের জন্য? বুদ্ধি ফোবিয়াতে দেশ আজ আক্রান্ত। ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকার মতই বুদ্ধিজীবীরা আসছেন। আসছেন প্রবাস থেকেও জ্ঞানের ঝাঁপি নিয়ে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ও বুদ্ধিজীবী সৃষ্টি করা হচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে। মুলধারার মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, গোলটেবিলে তারা সরব। কিন্তু জনতা নীরব। নিজের কাজ ও দায়িত্ব বাদ দিয়ে বুদ্ধিবাজরা বুদ্ধি বিতরণ করে যাচ্ছেন অকাতরে। দল মত নির্বিশেষে। ছুটা্ছুটি করছেন তারা। কার কি করিতে হইবে। আর কি করিতে হইবে না। ননস্টপ বলেই যাচ্ছেন এই বাচাল শ্রেণি (পযধঃঃবৎরহম পষধংং)। তাদের এই বচন গণমানুষের কোন কাজে আসে না। ‘লাগ ভেলকি লাগ দেশজনতার বিরুদ্ধে লাগ’ এমন অবস্থা। চারদিক বুদ্ধিজীবীর আনাগোনায় কিলবিল করছে। কাকের চেয়ে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বেশি । সাধারণ জনতা কোথায় (বলা হয়ে থাকে এ দেশের জনগণ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে না)? বুদ্ধিজীবীরা ভাবেন তারা যা বলবেন এদেশের সাধারণ মানুষ তাই তোতা পাখির বুলির মত বিশ্বাস করবে। বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবেন জ্ঞানপাপীদের কথা। বুদ্ধিজীবীরা দু’লাইন জ্ঞান বিতরণ করে ভাবছেন মুই কি হনুরে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কোন একটা পত্রিকায় (নাম মনে করতে না পারায় দুখিঃত) যেন পড়েছিলাম ‘হিটলার মনে করতেন, ইহুদিরা হচ্ছে প্লাটেনারি ব্যাসিলি, অর্থাৎ এই গ্রহের ভয়াবহ জীবাণু’। আর আজ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ মনে করছে ক্ষমতাবান তথাকথিত  উড়ে এসে জুড়ে বসা বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছেন এই দেশের প্লাটেনারী ব্যাসিলি।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রম্যলেখক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads