• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

অপরাজিত মানুষের বিশ্ব

  • শহীদ ইকবাল
  • প্রকাশিত ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের বসতি যখন থেকে শুরু তখনই ‘শ্রেণি’ তৈরি হয়েছে। মানুষ ছোট-বড় পার্থক্যে পড়েছে। সেটি ক্রমশ বাড়ছে। রাজা শশাঙ্কের সময় বড় মাছ ছোট মাছকে ধরে ধরে খেত— এমন একটা প্রতীকী কথা বলা হত। পরে পাল আমলে রাজাদের শাসন মন্দ ছিল না। উদার ও সহিষ্ণু ছিলেন সে রাজারা। রাজা পরে আরও আসেন। সেন আমল বা সুলতানি মোঘল আমলেও। রাজা কে? তিনি প্রভু, আদেশ করেন, দমন করেন, যা মন চায় করেন। শাসন তার হাতে। গর্দানও। কী যে কষ্ট সাধারণ মানুষের। রাজা সব কষ্ট দিতেন। কষ্টের কারাগার রচনা করতেন। এখনও পুরনো রাজবাড়িতে গেলে সেসব নজরে আসে। সেখানে জেলপ্রকোষ্ঠ আছে, কূপ আছে। ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হলে সব ভেসে যায়। রাজা-নবাব-সম্রাট সব। এমনকি রাজপুত্রও। এখনও মানুষ ওসব পুরনো ভেবে শখ করে ছেলের নাম রাখে, নবাব, রাজা কিংবা সম্রাট। আভিজাত্যের প্রতি সম্মান করে ওসব রাখে। অভিজাত ব্যাপারটা পছন্দ এখনও অনেকের। সেজন্য দেখা যায় কতো রকমের রঙ আর বাহার। এখনও যে নেই তা নয়। আছে। প্রচুর আছে। ব্যাপকভাবেই আছে। নইলে দীপিকা পাড়ুকোন বা রণবীর ওভাবে বিয়ে করবেন কেন। আর দর্শকই বা সেসব দেখে হাহাকার করবেন কেন। বেশ আশ্চর্য সব ঘটনা আমাদের এখন দেখার সুযোগ হয়, দেখতেও হয়। মিডিয়ার কল্যাণে। মিডিয়াও পেয়ে বসেছে। দর্শক যা চায় তার খোরাক তো দিতে হবে। দিয়ে যাচ্ছে। জামা-কাপড়, হোটেল, পারফিউম সবকিছুই তো ব্যবসা। সুযোগ নিচ্ছে। চতুর্দিকে সব রমরমা কারবার। যদি গরম আসে তবে সে ধরনের বিজ্ঞাপন, শীত এলে সেরকম, বৃষ্টি শুরু হলে সেরকম— সবকিছু যেন শিখিয়ে দিচ্ছে, শেখানোর ফলে চাহিদা বাড়ছে। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বাড়াছে। আয় যাদের হরদম হচ্ছে তাদের সমস্যা কম। আর যারা সীমিত তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে গিয়ে, অবক্ষয়ে ভুগছে, মন ভেঙে যাচ্ছে, অন্য পথের কথা ভাবছে; একসময় হয়তো প্রতিযোগিতায় নেমেও পড়ছে। এরকম ঘটনা হরহামেশাই চোখে পড়ে। পরিবারে-সমাজে অস্থিরতা প্রবল। তীব্র অস্থিরতা। এমনকি তা গড়াচ্ছে কোমলমতি সন্তানদের ওপরেও। কী করবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। পরিণতিও ভালো না। আনন্দ এখন ক্রুদ্ধ, উৎসব এখন অনান্তরিক, আশা এখন অভিপ্রেত কিছু। ফলে আনন্দ-আশা-উৎসব সবই তাৎপর্য হারাচ্ছে। বিষয়ও পাল্টে গেছে। মানুষ বদলেছে। সে বদলে পরিপক্বতা নেই। কেউবা শারীরিক বা অর্থ-ক্ষমতার জন্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঘটছেও। তেমন মানসিক বৃদ্ধি নেই। খুব দ্রুত সব বদলে গেলে, অনেক স্তর ধসে পড়ে। চেনা হয় না অনেক কিছুই। আর চেনা না হলে, ঠিক বোঝা যায় না। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে। আসলে সত্য-মিথ্যেতেও স্বাভাবিক কিছু অনুধাবন করা জটিল এখন। তাই প্রশ্ন, এসবের কারণ কী?

ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পরে পাশ্চাত্যে বেশ কিছু নামজাদা বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়। এসব বুদ্ধিজীবীগণ বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তায় প্রচুর পরিবর্তন আনেন। সে পরিবর্তনগুলো দেশে দেশে ছায়ার মতো কাজ করেছে। সে ছায়া জ্ঞানে এসেছে নতুন বার্তা। চিন্তায় এনেছে নতুন স্বর। যদি কান্টের কথা বলি, হেগেলের কথা বলি, ম্যাকায়েভিলির কথা বলি— তারা চিন্তায় ও ধারণায় বিস্তর ছড়িয়েছেন। বাংলা অঞ্চলে বঙ্কিমচন্দ্র, রামমোহন তাদের অনুসারী ছিলেন। শুধু অনুসরণ নয়, নিজেরা সেরকম করে সমাজে পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করেছেন। সে আন্দোলনের ধারায় বাংলা অঞ্চলে নবজাগরণ তৈরি হয়েছে। সমাজে নতুন পরিবর্তন আসলে পুরনোরা তা গ্রহণ করতে চান না। পুরনোদের নানান সংস্কার থাকে। আবার যে নতুন চিন্তার মানুষরা পরিবর্তন চাচ্ছেন তারাও সংস্কারাচ্ছন্ন থাকেন। ফলে পরিবর্তনের শক্তিটা ঠিক স্ববিরোধীতার দোলাচলতায় পড়ে যায়। এই স্ববিরোধিতা থেকে নতুন পরিবর্তন অনেক কিছুর ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে সময় নেয়। সে সময়টা আবার সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যতা পায় না। গ্রহণযোগ্যতা অর্জনেরও সময় লাগে। এর ভেতরে হয়তো সামাজিক উপযোগিতার বিষয়টিও আসে। সামাজিক উপযোগিতা যখন কাম্য হয় তখন প্রথাগত ধর্মচিন্তা-সমাজ-অভ্যাস সবকিছু ত্যাগ করে সে তা গ্রহণ করে। এই গ্রহণীয়তা একসময় সামাজিক পরিণতি পায়। এ পরিণতি আবার চলতিও হয়ে পড়ে। এই যে পরিবর্তনের ধারাস্রোত সেখানে এখন যা চলছে সেটার ভিত্তি কতোটুকু? সামজিক উপযোগিতার কেন্দ্রওবা কতোটুকু! বিষয়টি গুরুত্ব নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে। এমন ভাবনা থেকেই এ লেখা। যেটা বলছিলাম, এখন শোবিজের জগৎ চলছে। এ জগতে কারা সেলিব্রেটি, কাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে সেটা নির্ধারণ হয় গুণ-মান বিচারের চাইতে কে কতোটা এক্সপোজার তার ওপর। সে এক্সপোজিং-এর জন্য মিডিয়া লাগে। মিডিয়ার এ পিকনেস, দর্শকদের কতোটা খাওয়াতে পারবে তার ওপর। দর্শকের কী উপকার হবে সেটা নয়, দর্শক কীভাবে নেবে কোন ভাবে নেবে সেটার ওপর। এখন তো প্রিয়াংকা বা নিকির ছবি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিয়ে করছে। তাদের বোম্বে বিমানবন্দরে পুলিশ এসকর্ড করে নামাচ্ছে, নিরাপত্তা দিচ্ছে— দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, ফুল নিয়ে শুট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকজন— ক্রমশ পুরো পরিবেশ মিডিয়ায় চলে যাচ্ছে, মিডিয়া সেটি দিনভর প্রচার করে চলছে— এই তো একটা শ্রেণির সমাজ। আরও গভীরে গেলে আরও কথা তৈরি হবে। যেমন তারা কোন পোশাকে নামল, সে পোশাকটা কার ব্র্যান্ড, কোন ধরনের জুতো তাদের পায়ে ছিল ইত্যাদি। এভাবে একটা আবেগের তোড়ে আটকে গেছে একটি শ্রেণি। এই শ্রেণির অর্থ মোহ, বাজার দেখার আগ্রহ, নিজের যে জগত সেখানে অন্যকে ঠিক সেইভাবে গ্রহণ করার তীব্রময় মোহ। সেটাই প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। সেই ‘বিগবাজারে’র আলেকিত বিচ্ছুরণ পুঁজিপতিরা পৌঁছে দিচ্ছে সর্বস্তরের মানুষের কাছে। এই পৌঁছানোয় কোনো দায়িত্ব বা দায় নেই। ফলে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস জাতীয় সমস্ত বৈপরীত্য তৈরি হচ্ছে এবং তুলনামূলক অশিক্ষিত, দরিদ্র, অপরিপক্ব ভোক্তাদের হাতে পড়ে সমাজে উৎকট বিকারের জন্ম দিচ্ছে। এই বিকার ছড়িয়ে পড়ছে, সর্বস্তরে। রণবীর বা দীপিকার ওইসব জৌলুসপ্রবণ জীবনযাপন, উগ্র ভোগবাদী আলস্যময় জীবনের উপভোগ বিস্তৃত মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে। এক ধরনের পরিচয়ও ঘটছে। এই পরিচয়, সাধারণ মানুষের বৈষম্য জর্জরিত নিজস্ব জীবনযাপন থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। চলতি দৈনন্দিন বাস্তবতার ধরাছোঁয়ার একদম বাইরের। ফলে এ ঊর্ধ্বমুখী ধরাছোঁয়াবিহিন ঝাঁ-চকচক জীবনের পরিচয় প্রতি মুহূর্তে তাদের মধ্যে নেটধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, অথচ ‘তার সাথে হয়নাকো দেখা’। এই কর্পোরেট ওয়াল্ড থেকে আমাদের জনবহুল (যার অর্ধেকেরও বেশি দরিদ্র (!)) পৃথিবী মুক্ত নয়। আফ্রিকায়, এশিয়ায় অনেক মানুষের জীবন এখনও অসহিষ্ণু, মানবেতর। দেশে দেশে যুদ্ধ লেগে আছে। বর্ণবাদ, কুসংস্কার লেপ্টে আছে। এসব নিয়ে সেলিব্রেটিরা কিছু ভাবেন না। তাদের যাপিত জীবনের অর্থ দিয়ে পৃথিবীর অনেক মানুষের সমাজে স্বস্তি আসতে পারে। জীবনে সুখ আসতে পারে। অন্তত সেটুকু তারা করতে যদি নাও পারেন তবে এসব কোটি কোটি রুপীর বিয়ের অনুষ্ঠান, তাদের ব্যবহার্য সামগ্রী কিংবা ইটালী-নরওয়ের হানিমুন পাবলিক পোস্টে না দিলে— অন্তত বিকারটা তৈরি হয় না। সেটাও বুঝি কম হতো না। কিন্তু এটাও ঠিক, যে অন্তর্জাল বিশ্বে পৃথিবী আটকে গেছে— সেখানে সেইসব সেলিব্রেটিরা যা খরচ করছেন, তার দ্বিগুণ অর্থ হয়তো তারা আয়ও করে ফেলছে। আয়-ব্যয়ের হিসেবে তো কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড বিন্দুমাত্র ছাড় দেবে না! বস্তুত, লাভের বাজারে তারা যখন বেশি বাস্তববাদী। কিন্তু অন্ধকারে পড়ে থাকা বিস্তর জনতার খবর তারা রাখেন কী! সেটা বোধ করি তাদের জানারও প্রয়োজন নেই। বোধ করি সেটাই চলতি বিশ্বের সবচেয়ে ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজেডি সভ্যতা বহন করবে কতোদিন! এর পরিণাম কী শুভ?

একজন শেকসপিয়র, আইনস্টাইন এখনকার সমাজে নেই। এমনকি একজন অমর্ত্য সেন! বিষয়গুলো এই একুশ শতকের বিশ্বে অচিন্তনীয় কিছু নয় কিন্তু চিন্তা শুভপ্রদ মানুষদেরই করতে হয়। হবেও। আন্তর্জালিক বিশ্বে শ্রেণি ব্যবধান বাড়ছে। সোশ্যাল কনশাস কমছে। ব্যক্তিবাদীতা বাড়ছে। কিন্তু সমাজে ব্যক্তি তো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এক অর্থে, ব্যক্তি তো বিচ্ছিন্ন শব্দ। যদি সেটা চক্রাকারে বাড়ে, তবে সমাজ পিছিয়ে যাবে। সামষ্টিক-বুননী ঝুলে যাবে। সেটা ঘটলে নিরাপত্তহীনতাও বাড়বে। অন্ধকার বেশি তৈরি হবে। তখন অর্থ যাদের আছে, ভাড়া করা লোক নিয়ে এসে বাড়ি পাহারা দিতে হবে। কিন্তু সে পাহারা যে পাহারা নয়— তা কে বুঝবে? টাকা দিয়ে ঠ্যাকা সরানো যায় কিন্তু মানুষের মন বা আস্থা অর্জন করা যায় না। সেটি পেতে হলে, অর্থে মুখ্য নয়, সামষ্টিক উদ্যোগ বা সোশ্যালাইজেশন জরুরি। সেটা এখন হুমকীর মুখে। এই হুমকীর কথা এ সময়ে ভাবার সময়ও কম। কারণ, মিথ্যে মোহাচ্ছন্নতা গ্রাস করেছে সব। আর যে সমস্যাটা অদূরে সেটা এখনও কাছের হয়নি, তাই বুঝতে কিছুটা সময় লাগছে। সমাজের প্রবণতাগুলো দেখলেই আমরা বুঝতে পারি। আজকে দলের টিকেট পাওয়ার জন্য, খুনোখুনি শুরু হয়েছে। দল বদলের হিড়িক চলছে। পদবঞ্চিতরা হতাশ হয়ে অন্য দলে চলে যাচ্ছেন। এসবের অর্থ কী? কেউই জনসেবার জন্য এসব করছে কী? কোনো আদর্শের জন্যও কী? অবশ্যই নয়। শুধু চার্ম আর আভিষেকের লোভ ছাড়া আর কী! তাদের মগজ ওই একটা ‘ওয়ার্ল্ডে’ আটকে গেছে। সেখানে শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-শ্রম সবকিছু গৌণ। মুখ্য হয়ে উঠেছে, ভোটের মাঠ দখল করতে হবে। সেটি দখলে পেলেই পাঁচ বছর নিশ্চিন্ত। যা চাই তা পাওয়া যাবে। কেউ কিছু বলবে না, বললেও সেটা কাজে দেবে না। ফলে ওই টিকেট পাওয়াটা যে কোনো মূল্যে খুব জরুরি। অপেক্ষার তর সইছে না। কারণ, পাঁচ বছর মানে অনেক সময়। যা চাচ্ছি তেমন সুদিন আর নাও ফিরতে পারে। ফলে একটা অপরিচ্ছন্ন, গ্লানিকর, দেউলিয়া জীবনের মোহে আকৃষ্ট এই সমাজ। সেটা কাগজের পাতা খুললেই বোঝা যায়। এ থেকে মুক্তি দরকার। কার্ল মার্কস, যতো বিতর্কিত হন, তাঁর সমাজে যে সাম্যতত্ত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠিত, সেটি এই ‘লেট ক্যাপিটালিজমে’র তত্ত্বেও এখন প্রমাণিত। এ থেকে মানুষের মুক্তির আলাদা কোনো পথ আছে কী? কান টানলে মাথা আসার মতো একটি অর্ডারেই অনেককিছু পরিবর্তন আসতে পারে। সে অর্ডারটা মানুষের ভেতর থেকেই আসতে হবে। নিশ্চয়ই তা আসবে। কারণ, পৃথিবী নামক গ্রহটি মানুষেরই বাসস্থান, সে স্বার্থে মানুষ পরাজিত হবে কেন!

 

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads