• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

কীভাবে করা যায় মেধা অন্বেষণ ও প্রস্ফুটন

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮

আমাদের দেশে পঞ্চম শ্রেণিতে একটি পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয় ২০১০ সাল থেকে। এই পরীক্ষা শুরুর আগেও আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল বিধায় এই পরীক্ষা পাস করার পরপরই শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে অর্থাৎ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতো, এখনো তা-ই হচ্ছে। মাধ্যমিকে ভর্তির পরপরই পুনরায় শুরু হয় ক্লাস, পড়া, প্রাইভেট পড়া, পরীক্ষা, পরীক্ষার ফলের জন্য দুশ্চিন্তা ইত্যাদি। অতিসম্প্রতি সরকার বিভিন্ন শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের মতামতের গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিকে সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। একইভাবে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করে শিক্ষার্থীরা কলেজে ভর্তি হয়। সেখানেও একই নিয়ম, একই ধরন, একই একাডেমিক চক্রে তারা আটকে যায়। নেই কোনো ব্যতিক্রম, নেই কোনো আনন্দ, নেই কোনো সৃজনশীল কাজ। নিরানন্দ আর টেনশনেই কাটে পুরো শিক্ষাজীবন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসব বিষয়ে অনেকটা মুক্ত অবস্থা বিরাজ করে কিন্তু পরবর্তী জীবনে প্রবেশ, কাজের সন্ধান, পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ ইত্যাদি বিষয় পেয়ে বসে আর তাই পুরো শিক্ষাজীবনই অনেকটা দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটে। এসব বাস্তবতার মধ্যেও আনন্দ খুঁজতে হবে, সময় বের করে নিতে হবে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড করার জন্য।

একঘেয়েমি দূর করার জন্য এবং শিক্ষার্থীদের মেধা আবিষ্কারের জন্য, তাদের প্রকৃত সৃজনশীলতা বের করার জন্য ভর্তি হওয়ার পরপরই বিদ্যালয়গুলো আয়োজন করতে পারে এক ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ বা মেধা অন্বেষণ কার্যাবলি। আয়োজন করতে পারে যার যা ভালো লাগে, যে যাতে মজা পাও, যে যা করতে চাও তা-ই করো বিনা দ্বিধায়’ ধরনের একটি প্রোগ্রাম।

যদি বলা হয়, তোমাদের মধ্যে যারা নাটক করতে চাও তারা নাটকের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাক, তোমাদের বাংলা স্যার সহায়তা করবেন। যারা কবিতা আবৃত্তি করতে পার, তারা কবিতা আবৃত্তির জন্য প্রস্তুতি নাও। যারা গান গাইতে পার, তারা গানের জন্য প্রস্তুতি নাও। যারা গল্প লিখতে চাও বা পছন্দ কর, তারা গল্প লেখা শুরু করে দাও।’ এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন এক ধরনের আনন্দের সঞ্চার হবে, শিক্ষাভীতি ও পরীক্ষাভীতি দূর হবে, শিক্ষকদের সঙ্গে আলাদা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হবে, যেটি কার্যকর শিক্ষাদান পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই বিদ্যালয়ে লাজুক থাকে, তাদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা প্রতিভার খোঁজ তারা নিজেরাও জানে না। যার যতটুকু আছে তা প্রকাশ করার বা প্রস্ফুটিত করার কোনো সুযোগও পায় না। পরীক্ষার পড়া আর প্রাইভেট পড়ার চাপে। এ অবস্থায় শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সবাইকে উৎসাহিত করা এসব কোনো না কোনো কিছু করার জন্য। যখন একজন শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীর ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রতিভা বের করে আনতে পারবেন, সেটিই শিক্ষক হিসেবে তার প্রকৃত সার্থকতা। কিন্তু আমরা অধিকাংশ শিক্ষক ও অভিভাবক মনে করি একজন শিক্ষার্থীকে বাংলায় ৮০, ইংরেজিতে ৮০ পাইয়ে দিতে পারলেই যেন প্রকৃত সার্থক শিক্ষক। যেসব শিক্ষক শুধু এসব কাজ করেন, তাদের পেছনে ছোটেন অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও সমাজ। তাদের বাহবা দেন। ফলে চাপা পড়ে যায় শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা। প্রস্ফুটিত হয় না তাদের প্রতিভা। অথচ এই প্রতিভা একজন শিক্ষার্থীর নিজের জীবনে, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রভূত কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়ে যদি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতে পারে এবং সেই সুযোগটি যদি স্কুল থেকে তাকে করে দেওয়া হয়, তাহলে ওই ছেলে বা মেয়েটি নিশ্চয়ই স্কুলের প্রতি আলাদা সম্মান, শ্রদ্ধা ও অনুভূতি প্রকাশ করবে। সারা জীবন মনে রাখবে  স্কুলের এই অবদানকে। ওই স্কুলকে এবং যে শিক্ষক বেশি ও সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাকে মনে করবে সারা জীবন। অন্যকে বলবে, তার অনুজ শিক্ষার্থীর জন্য সে অনেক কিছু করার চেষ্টা করবে। স্কুল আবিষ্কার করবে কোন ছেলেটি বা মেয়েটি কবিতা আবৃত্তি করতে পারে, কোন ছেলেটি বা মেয়েটির নাচের প্রতি ঝোঁক আছে ইত্যাদি। তারপর তাকে উৎসাহ প্রদান করা, প্র্যাকটিস করার সুযোগ করে দেওয়া, জনসমক্ষে এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেওয়া। এসব সাহায্য স্কুলে থেকেই পাওয়ার কথা, শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা থেকে পাওয়ার কথা। এ বিষয়গুলো আমরা বিদ্যালয়ে একেবারেই চিন্তা করি না। চিন্তা করার আসলে অবকাশ নেই পাবলিক পরীক্ষা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে। বর্তমানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েও যেন হলো না। বিষয়টি নিয়ে ভাবার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। শিশুরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ছিল কিন্তু তা আর হলো না। অভিভাবকদের আবারো শিক্ষক, কোচিং আর প্রাইভেট নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য বাচ্চাদের চাপ দিতে হবে। এসব কারণেই অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের একাডেমিকবহির্ভূত কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করাতে উৎসাহিত তো করেনই না, বরং নিরুৎসাহিত করেন এবং বলেন, ‘খেলাধুলা ও বাইরের বই পড়ে অনেক সময় নষ্ট করেছ, এবার থেকে পড়াশোনা শুরু কর।’ অর্থাৎ একাডেমিক পড়াশোনার বাইরের কার্যাবলি বা পড়াশোনাকে তারা মনে করেন সময় নষ্টের কাজ। অথচ বিশ্বের নামকরা ব্যক্তিদের অধিকাংশই শুধু একাডেমিক বিষয় নিয়ে পড়ে থাকেননি। বিশ্বের অনেক নামকরা খেলোয়াড়, বিজ্ঞানী, শিল্পী, গায়ক তাদের অনেকেরই একাডেমিক জীবন সেই অর্থে উজ্জ্বল নয়; অথচ তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের মেধা, প্রকৃত সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তাদের সঙ্গে শুধু একাডেমিক বিষয় নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করতেন কিংবা ব্যস্ত থাকতেন, তাদের নাম কিন্তু আমরা জানি না। তাদের ছাড়িয়ে বহুগুণ এগিয়ে আছে এসব বিখ্যাত ব্যক্তি। এ ধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও উদাহরণ আমরা সবসময়ই দেখতে পাই। বিদ্যালয়ে এগুলো যদি চিন্তা করা না হয়, তাহলে তো শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসার আগ্রহ ও ইচ্ছা কোনোটাই থাকবে না। শুধু একাডেমিক কারণে তো বিদ্যালয়ে আসার, বিশেষ করে নিয়মিত আসার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। শিক্ষার্থীরা নিজেরা পড়াশোনা করে কোনো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাইভেট শিক্ষার্থী হিসেবেও পরীক্ষা দিতে পারে। বিদ্যালয়ের দায়িত্বগুলো এখানেই বেশি।

আমরা জানি, দেশের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে চায় না, তাদের শাস্তি দিয়ে, ভীতি প্রদর্শন করে ক্লাসে নিয়ে আসা হয়। যেমন ক্লাসে না এলে সবার সামনে দাঁড়িয়ে রাখা, কান ধরে ওঠবস করানো, জরিমানা করা, টার্ম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া ইত্যাদি ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা হয় এবং ওইসব প্রতিষ্ঠান সমাজের বাহবা কুড়ায়। ক্লাসের টানে, শিক্ষকের টানে, পাঠের আকর্ষণের কারণে কিন্তু শিক্ষার্থীরা অনেকেই নিয়মিত ক্লাসে আসে না।

প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। একেক পরিবেশে একেক ধরনের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তৈরি হয়। এই প্রতিভা বিকাশের দায়িত্ব ও সুযোগ করে দেওয়ার কাজ বাবা-মায়ের পরে শিক্ষকদের। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদেরই এই দায়িত্বটা যেন বেশি। সার্বিকভাবে এটি বিদ্যালয়েরই দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে তা হচ্ছে কি? বিদ্যালয়ের মূল কাজই হওয়া উচিত শিক্ষার্থীদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের অবদান রাখার সুযোগ করে দেওয়া। আর প্রকৃত প্রতিভার বিকাশ শুধু একাডেমিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকলে হয় না।

 

লেখক : ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

সধংঁসনরষষধয৬৫—মসধরষ.পড়স

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads