• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

আমাদের মাস ডিসেম্বর

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮

বিজয়ের মাস বলে শুধু নয়, আরো কিছু বিশেষ বিষয় ও ঘটনার কারণেও ডিসেম্বরকে বাংলাদেশের মাস বলা যায়। এসব বিষয় ও ঘটনা সম্পর্কে আলাদাভাবে বিস্তারিত লেখা যথেষ্ট কঠিন কাজ। প্রতিটির উল্লেখ করাও একটিমাত্র নিবন্ধে সম্ভব নয়। শুনে পাঠকরা ক্ষুণ্ন হতে পারেন, কিন্তু আসলেই কথাটা সত্য।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের কথাই ধরা যাক। সেবার ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়ী হয়েছিল। সে ছিল এক ঐতিহাসিক বিজয়। কিন্তু ‘পশ্চিম পাকিস্তানে’র ধুরন্ধর রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরোধিতার অজুহাত দেখিয়ে সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার মাধ্যমে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তারপর শেখ মুজিবের সঙ্গে সমঝোতা ও আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণের পাশাপাশি গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই গণহত্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ। সেটাও এক ঐতিহাসিক ঘটনাই, যার পেছনে ছিল আগের বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর। এ প্রসঙ্গে যে কোনো আলোচনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাস যেমন আনতে হবে তেমনি তুলে ধরতে হবে নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহও। এতে শুধু শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বললে চলবে না, পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও দলটির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর উদ্ভট আবদার সম্পর্কেও লিখতে হবে। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে নতুন নজির সৃষ্টি করে তিনি দুই প্রদেশের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানিয়েছিলেন। সেটাই ছিল সঙ্কটের আশু এবং প্রধান কারণ, যার পরিণতি ছিল পাকিস্তানের ভাঙন এবং স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বর সম্পর্কে লিখতে হলে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর কথাও বলতে হবে। কারণ আগের মাস নভেম্বরে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও বিপুল ধ্বংসের পর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেওয়ার প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী একদিকে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলেন, অন্যদিকে পূর্ব বাংলা তথা ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে, ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় ‘ওরা কেউ আসেনি’ বলে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি পাকিস্তানিদের উদ্দেশে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন’। পবিত্র কোরআনের সুরা কাফেরুনের এ আয়াতটির রাজনৈতিক অর্থ ছিল, তোমরা— ‘পশ্চিম পাকিস্তানিরা’ তোমাদের মতো থাকো। আমরা, বাঙালিরা থাকব আমাদের মতো। এটা ছিল প্রকাশ্যে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা।

উল্লেখ্য, একই নেতা মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’কে ‘আসসালামু আলাইকুম’ তথা বিদায় জানানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ‘লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন’ উচ্চারণের পাশাপাশি মওলানা ভাসানী নির্বাচন বয়কট করায় আওয়ামী লীগের জন্য বিজয় অর্জন করা সহজ হয়েছিল। কারণ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ দ্বিতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল। মওলানা ভাসানী ও তার দল নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের পক্ষে এককভাবে নিরংকুশ বিজয় অর্জন করা সম্ভব হতো না, ঘটনাপ্রবাহও স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করত না। সেদিক থেকেও অতুলনীয় হয়ে আছে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর। মওলানা ভাসানীর এ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো কেউ কেউ ছেলের মতো মুজিবের পক্ষে একটি ‘মাস্টার স্ট্রোক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। পল্টন ময়দানে দেওয়া মওলানা ভাসানীর এই বক্তৃতার প্রতিক্রিয়াতেই কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘সফেদ পাঞ্জাবী’। এর শেষ ছয়টি লাইন ছিল, ‘...যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগর/হায়; আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী।/বল্লমের মত ঝলসে ওঠে তার হাত বারবার/ অতিদ্রুত স্ফীত হয়, স্ফীত হয় মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবী/ যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবী দিয়ে সব/বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।’  

ডিসেম্বর মাস সম্পর্কে লিখতে হলে আরো অনেক প্রসঙ্গই টেনে আনতে হবে, যা একটিমাত্র নিবন্ধে সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা দরকার। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে ক্ষমতা দখলকারী মইন-ফখরুদ্দীনদের উদ্যোগে আয়োজিত ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল। অবশ্য বিরোধী দলগুলোর ভাষায় এটা ছিল ‘ডিজিটাল’ নির্বাচন। কারণ বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের মতো এই নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি— ঘটতে দেওয়া হয়নি। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছিল, ২০০৬ সালের অক্টোবরে সংঘটিত লগি-বৈঠার হত্যা ও নৃশংসতা থেকে জরুরি অবস্থা জারি এবং নির্বাচন আয়োজন পর্যন্ত সবই করা হয়েছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে, যার নাম ছিল ‘রোডম্যাপ’।

এবার আরো এক ডিসেম্বর মাসের প্রসঙ্গ। এই ডিসেম্বর ২০১৩ সালের। পরের মাস অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশ তখন উত্তাল। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ১৮ দলীয় জোটের ডাকে পালিত অবরোধ দেশকে আক্ষরিক অর্থেই অচল করে ফেলেছিল। শহরে-নগরে তো বটেই, সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রামাঞ্চলেও। প্রতিদিন মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটছিল অসংখ্য মানুষের। অনেক জেলায় মনোনয়নপত্র এবং নির্বাচনের কাগজপত্র পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছিল না। বহু এলাকায় নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ছিলেন জনগণের ধাওয়ার মুখে। কিন্তু অমন এক অবস্থার মধ্যেও অনুষ্ঠিত হয়েছিল দশম সংসদের জন্য নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সরকারের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করার অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেছিল। বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট অবরোধের ডাকও দিয়েছিল। ফলে অচল হয়ে পড়েছিল সারা দেশ।

এমন অবস্থার মধ্যেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় ১৫৪ জন সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। মূলত সে কারণেই দশম সংসদকে নিয়ে এখনো সমালোচনার অবসান হয়নি। তা সত্ত্বেও ওই সংসদ তার মেয়াদ পূর্ণ করেছে এবং আগামী ৩০ ডিসেম্বর আরো একটি অর্থাৎ একাদশ সংসদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এ নির্বাচন অবশ্য স্বাভাবিকভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অংশ নেওয়ার-না নেওয়ার বিষয়ে দীর্ঘদিন পর্যন্ত জনগণকে সিদ্ধান্তহীনতায় রেখেছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও বিরোধী দলের হাতে একের পর এক আপত্তি ও প্রতিবাদের কারণ ও অজুহাত তুলে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও বিরোধী দল লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত না করার অভিযোগ তুলেছে। এই প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের রেকর্ড তৈরির অভিযোগও উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে গণগ্রেফতার ও গায়েবি মামলায় জড়ানোর ব্যাপারে। বিরোধী দলের অনেক প্রার্থীকেও গ্রেফতার করা হচ্ছে। দলগুলোকে প্রচার-প্রচারণার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মতো সমান সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ তুলেছেন নেতারা। এভাবেই দেশ এগিয়ে চলেছে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পথে। সেটাও বাংলাদেশের মাস ডিসেম্বরেই। এ বিষয়ে শেষকথা বলার সময় এখনো আসেনি।

এ পর্যন্ত এসে পাঠকদের মনে হতে পারে, যেন ডিসেম্বর কেবলই নির্বাচনের মাস। অন্যদিকে ডিসেম্বর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের মাস হিসেবে। কারণ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিলাম। ইতিহাসের ওই অধ্যায় সম্পর্কে পরবর্তী নিবন্ধে লেখার ইচ্ছা রইল।

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads