• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
গজারি গাছে বাঁধা ছিল তাদের নিথর দেহ

ছবি : সংগৃহীত

মতামত

মুক্তিযুদ্ধ

গজারি গাছে বাঁধা ছিল তাদের নিথর দেহ

  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বিয়ে হয়েছে এই তো অল্প ক’দিন হলো, হাতে মেহেদির রঙ লেগে আছে তখনো। অগ্রহায়ণ মাস। চারদিকে ধান কাটার ধুম পড়েছে। গোলাভরা ধান, কৃষাণ-কৃষাণির চোখে-মুখে আনন্দের হাসি। শিরিনার চোখে-মুখেও ছিল আনন্দের হাসি, ছিল বুকভরা আশা এবং স্বামীর জন্য জিইয়ে রাখা পবিত্র ভালোবাসা। কিন্তু হঠাৎ এক রাতের মধ্যেই সব তছনছ হয়ে গেল। সুখের সংসার, স্বামীর সোহাগ, শ্বশুর-শাশুড়ির আদর ভালোবাসা সব যেন বিহারিদের লালসার কবলে পুড়ে অঙ্গার হলো। এক নিমিষেই সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তিন রাত পর সংবাদ এলো জঙ্গলে শিরিনার নিথর নগ্ন মৃতদেহ গজারি গাছের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে।

 

শিরিনা খাতুন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার কর্ণপুরের আকন্দ বাড়ির রিয়াজুদ্দিন আকন্দের মেয়ে। বিয়ে হয় একই উপজেলার সাতখামাইর গ্রামের আবদুল লতিফের ছেলে আবদুল কুদ্দুসের সঙ্গে। বিয়ের পর দুই মাস স্বামীর সঙ্গে খুব সুখেই দিন কাটে। এরই মধ্যে দেশে যুদ্ধ লেগে যায়। শেখ সাহেবের ৭ মার্চের ভাষণের পর বাংলার দামাল ছেলেরা দেশমাতৃকা রক্ষায় যার কাছে যা আছে তা-ই নিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনতে যুদ্ধে নেমে পড়ে। আর পাকিস্তানিরাও হয়ে ওঠে বনের পশুর চেয়েও হিংস্র। সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ক্যাম্প স্থাপন করে ধর্ষণ, গণহত্যা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ শুরু করে। মা-বোনদের ইজ্জত হরণ শেষে বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে যত্রতত্র ফেলে রাখে তাদের নগ্ন মৃতদেহ। শ্রীপুরের নববধূ শিরিনা খাতুনকেও সেদিন এভাবে পালাক্রমে ধর্ষণ করে বেয়নেটের আঘাতে শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে নির্মমভাবে খুন করে পাকিস্তানি নরপশুর দল।

 

শিরিনা খাতুনের স্বামী আবদুল কুদ্দুসের ভাষ্যমতে, পাকসেনারা শ্রীপুরে ক্যাম্প করার পর রাতে আমরা যুবকরা ভয়ে বাড়ি থাকতাম না। ঘটনার দিন রাতেও আমি আর আমার ভাই ইদ্রিস আলী সাতখামাইর রেলস্টেশনের দিকে ছিলাম। সেদিন খুব সম্ভবত মঙ্গলবার কিংবা বুধবার ছিল। ঠিক রাত এগারোটার দিকে রেলের দুটি ডাব্বা ভরে বিশ-পঁচিশ জনের পাকসেনাদের একটি দল সাতখামাইর এসে হঠাৎ আমাদের ঘিরে ফেলে। তারা আমাদের বলে ‘তুমলোক ইদার থাকো, হামলোক এক ঘণ্টামে আজাওঙ্গা।’ আমরা ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আধঘণ্টা পরেই দেখি আমাদের গ্রামের দিকে শুধু আগুন দেখা যাচ্ছে আর চিৎকারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে এসে দেখি আমার থাকার ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমার বাবা আবদুল লতিফ, সদ্য বিয়ে করা বউ শিরিনা খাতুন, ভাতিজি সালেহা বেগম, সালেহা বেগমের শাশুড়ি সখিনা এদের ধরে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার বাবাসহ একই এলাকার মোট এগারো জনকে সাতখামাইর বাজারের উত্তর পাশে নিয়ে চোখ বেঁধে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। জায়গাটি এখন শ্রীপুরের দুটি বধ্যভূমির একটি হিসেবে পরিচিত। আমার স্ত্রী শিরিনা খাতুন এবং ভাতিজি সালেহা বেগম ও সখিনাকে শ্রীপুর ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। যেদিন রাতে ধরে নিয়ে যায়, তার ঠিক দুই রাত পরে একদিন লোকমুখে শুনলাম উপজেলার বিন্দুবাড়ির দিকে জঙ্গলে তাদের ক্ষতবিক্ষত উলঙ্গ দেহ গজারি গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় দেখা গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তাদের লাশ আনতে পারিনি। পাকসেনারা আশপাশেই টহল দিচ্ছিল। অনেকদিন পর আমার স্ত্রী ও ভাতিজির কঙ্কাল কুড়িয়ে আনি।

 

এ ঘটনার জ্বলন্ত সাক্ষী সাতখামাইর গ্রামের পাশেই দরগারচালা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা, উপজেলার সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মো. গিয়াস উদ্দিন কমান্ডার। তিনি এ ভয়াবহ পাশবিক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হয়েছেন। স্থানীয় রাজাকার নূরে আলম, চানু চৌকিদার, নওয়াব আলী মোড়ল ও হযরত আলী মোড়লদের সহযোগিতায় সাতখামাইর গ্রামের কুদ্দুসের নববধূ শিরিনা খাতুনসহ আরো অনেককেই সেদিন তুলে নিয়ে শ্রীপুর ক্যাম্পে দিনের পর দিন তাদের ওপর চলে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। এমনকি ব্রিজের নিচে তাদের স্পর্শকাতর জায়গার মাংসপিণ্ডগুলো পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আর নগ্ন মৃতদেহ গজারি গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

 

পরে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা মো. গিয়াস উদ্দিন কমান্ডারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে গোলাঘাট পাকসেনাদের ক্যাম্প ধ্বংস করে এবং পরে শ্রীপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে শত্রুসেনাদের প্রধান ক্যাম্পের তিন দিক থেকে মোট পাঁচটি সেক্টরে ভাগ হয়ে একযোগে আক্রমণ চালায়। ফলে পাকসেনারা দিগ্বিদিক হয়ে কোনো উপায়ান্তর না দেখে শ্রীপুর ত্যাগ করে। ১২ ডিসেম্বর সকাল আটটার দিকে শত শত মানুষের উপস্থিতিতে শ্রীপুর ডাকবাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শ্রীপুরকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয়।

 

সোলায়মান মোহাম্মদ

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads