• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
শেষ ভালো যার, সব ভালো তার

স্বাধীনতার পর এবারই সম্ভবত সর্বোচ্চ নমিনেশনপত্র জমা পড়েছে

সংগৃহীত ছবি

মতামত

শেষ ভালো যার, সব ভালো তার

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮

সমাজে অস্থিরতা, হতাশা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। খুন খারাবি, জিম্মি রাহাজানি এমনকি গ্রিল কাটা চোরের উপদ্রব বেড়ে গেছে। এ ছাড়া হকার রাস্তার ওপর বাজার কোনোটারই কমতি নেই। ফুটপাথ রাস্তার ওপর বাজারে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে গেছে। দুর্ঘটনা, রোড এক্সিডেন্ট, রকমারি আন্দোলন সংগ্রামে চারদিক এখন মুখর।

নির্বাচনী গরম হাওয়ার অস্থিরতা তো আছেই, বছরের শেষ প্রান্তে দেশ এখন নানা জটিলতায় আক্রান্ত। নির্বাচনের মাসে প্যারেড গ্রাউন্ডের কুচকাওয়াজ স্থগিত। তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা স্থগিত। তাবলিগও দ্বিখণ্ডিত নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে। মাঠ দখল নিয়ে এখন জেলায় জেলায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ছড়িয়ে পড়ছে। এতে কার লাভ আর কার লোকসান বলা মুশকিল। অথবা কারা কলকাঠি নাড়ছে তা অজানা। তাদের অভিযোগের শেষ নেই। সব জায়গায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অভিযোগ। রাজনীতিতে এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যের ব্যাপক রসালো আলোচনা চলছে। প্রায় সব দলেই এ বাণিজ্যের কথা উঠে এসেছে। এখানে বাণিজ্যের গন্ধ তো উঠে আসবেই। নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেওয়া ২৫ লাখ টাকায় তো আর কেউ নির্বাচন করে পাস করে আসতে পারবে না। বাংলাদেশের নির্বাচন এক ব্যয়বহুল উৎসব। পাস করে সংসদে যেতে হলে রাজনীতিবিদদের গাঁটের টাকা প্রায় ফতুর করেই যেতে হয়। টাকা না হয় সমর্থন আর না হয় পেশিশক্তি অনেক সময় দেখা যায়। এসবের কিছুই লাগে না, জন জোয়ারে সব ভেসে যায়।

ধনী, ব্যবসায়ীরা তো এমনি সময়ে নির্বাচনী এলাকায় যান না। এলাকার সাথে, স্বজনের সাথে, সমাজের সাথে ওঠবস করেন না। তাদের খায়খরচা একটু বেশিই হয়। আর যারা সরকারে থাকেন তাদের খরচ বেড়ে যায় কর্মীদের সামাল দিতে, কামানো গাঁটের পয়সা ফতুরের পর্যায়ে চলে যায়। তবুও ভালো গ্রামগঞ্জের মানুষ নির্বাচনের সময়ে একটু নেতার মুখ দর্শন পায়, ভালোমন্দ খায়। চা পান থেকে সিগারেট ফোকে, একটু ফুরফুরে ভাব থাকে, কিন্তু এবার যেন একটু কেমন কেমন ঠেকছে। হঠাৎ হঠাৎ নানা খণ্ডচিত্রে অস্থিরতা ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘমালার অস্থিরতার সমাজে নাটকীয় অস্থিরতা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখন কার কপাল পোড়ে বলা মুশকিল।

তাবলগিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষ টঙ্গীর মাঠ দখলে অনড় ছিল। ১ জন নিহত এবং হাজার হাজার আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আলেম সমাজের ওপর এক গায়েবি নির্যাতন শুরু হয়েছে এ দেশে। হেফাজতে ইসলাম মার খেয়ে কী কৌশলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলা মুশকিল। আবার মাঠে, হামলার ঘটনায় আজ্ঞাতনামা ২৫ হাজার আসামির পুলিশি মামলা কী ইঙ্গিত বহন করে, বিজ্ঞজনেরা ভালো বলতে পারবেন। এ সরকার আবার ফিরে আসলে হয়তো তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষই ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাংলাদেশে এখন কৌশলের রাজনীতি চলছে। অপকৌশল তো আছেই। কৌশল-অপকৌশলের মারপ্যাঁচে কে জিতে আর কে হারে দেখা যাবে ৩০ ডিসেম্বরের পর। গ্রামে একটি কথা প্রচলিত আছে, এত ভালো ভালো না। সময় হলেই ভালোর জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়।

জাতীয় পার্টির মানিক জোড় এরশাদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার তাদের বিকল্প ছিল না, হঠাৎ করেই লুকোচুরি খেলতে খেলতে এরশাদ সাহেব সিএমএইচে ঘন ঘন চেকআপে যেতে লাগলেন এবং এক দিন সবাই প্রত্যক্ষ করল সব ধামাচাপা দেওয়ার জন্য রুহুল আমিন হাওলাদার বলির পাঁঠা হয়ে গেলেন। অতীতেও এরকমটি হয়েছে। বিএনপি, ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনীমুখিতায় এরশাদের জাতীয় পার্টি এখন কোন কৌশলে এগুবে, তা দেখার বিষয়।

সমাজে অস্থিরতার কথা বলছিলাম। একটি নামিদামি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের আচরণগত জটিলতায় এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা সমাজকে, রাষ্ট্রকে নাড়া দিয়ে বসেছে। স্কুল এবং শিক্ষক অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান দায় এড়াতে পারে না। সব বাবা-মাকে সন্তানের প্রতি আরো সচেতন হতে হবে, তাদের দৃঢ় মনোবলের অধিকারী করে গড়ে তুলতে হবে। না হয় এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি সরকারের আরো মনোযোগী হতে হবে। বিস্ফোরণোন্মুখ সমাজ যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরিত হতে পারে। এ ঘটনায় সরকার তড়িৎ পদক্ষেপ নেওয়ায় পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সব স্কুল কলেজে এখন ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত। পরীক্ষার পর শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ।

এ মাস হলো আনন্দ-বেদনার মাস। বিজয় দিবস সামনে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমাদের স্মৃতি আনন্দ বেদনায় ভরপুর। আমরা দেখেছি লুট, হত্যা, ধর্ষণ-গুম, জ্বালাও পোড়াও, উজাড় গ্রাম, সহযোদ্ধার লাশ। প্রিয় শিক্ষক আওয়াল স্যারের লাশ ভেসে যেতে দেখেছি সোমেশ্বরীর বুকে। সোমেশ্বরীর নদীর পারে এম্বুশে থেকে। মজিদ রাজাকার কমান্ডারের তাণ্ডব দেখেছি। আবার ১৬ ডিসেম্বর আমাদের আনন্দাশ্রু অবগাহন করেই আমরা এগিয়ে গেছি সম্মুখে। এত বছর পর কী পেলাম আর কী পেলাম না, সেই বিচার আর করি না। দেশ স্বাধীন, স্বাধীনতার সব সুফল সমভাবে বণ্টন যে হয়নি এটা এখন বলা যায়। যারা স্বাধীনতার সুফল এখন পরিপূর্ণভাবে ভোগ করছে তার অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সেইভাবে সম্পৃক্ত ছিল না। আর যারা ত্যাগী যোদ্ধা, তারা মূল ধারা থেকে ছিটকে পড়েছে। এখানেও জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করা হয়েছে। এখন চলছে ইসলামিক নানা দল ও সংগঠনকে দ্বিধা-বিভক্তির কাজ। এবং তা একরকম ভালোভাবেই চলছে। এক মুসলিম আরেক মুসলিমের মাথা ফাটিয়ে উল্লাস করছে।

আমরা সেই অমর বাণী ভুলেই গেছি— একজন মুসলিম আর একজন মুসলিম থেকে অনিরাপদ থাকবে না। অর্থাৎ একজন মুসলিম কখনোই আরেকজন মুসলিম দ্বারা আক্রান্ত হবে না। পৃথিবীর দেশে দেশে আজ কী দেখি? নবীজীর (সা.) আদর্শ থেকে সরে গিয়ে ফ্যাতনা ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়ছে অধিকাংশ। তা থেকে আমাদের দেশও বাদ নেই। ছোটখাটো বিষয় যেগুলো আলোচনায় শেষ করা যায় সেগুলো মারদাঙ্গায় রূপান্তর করা হচ্ছে। ইসলামের সৌন্দর্যকে নষ্ট করা হচ্ছে।

বিজয়ের মাসে দেশ জনগণের কল্যাণে যেখানে সবার ঐক্যবদ্ধ থেকে দেশের কিসে ভালো হয় সে চিন্তা না করে, বরং কিসে নিজেরা টিকে থাকবে সেই সঙ্কীর্ণ চিন্তায় সবাই মগ্ন। দেশ তো সবার। সবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব। আমাদের অহঙ্কার ও অর্জন। গুটিকতক উচ্চাভিলাষী মানুষের জন্য যেন নষ্ট হয়ে না যায়। আমাদের অর্জন যাতে ভেস্তে না যায় সবার সজাগ থাকতে হবে।

বিন্দু পরিমাণ যাতে কালিমা লেপন কেউ করতে না পারে। আমাদের শহীদের রক্ত যাতে কেউ ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে না পারে সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্তরক্ষী ও সেনাবাহিনীকে সদাজাগ্রত থাকতে হবে। কোনো প্ররোচনায় যেন তারা সম্পৃক্ত না হয়। দেশ তাদের কাছে সেই সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব প্রত্যাশা করে।

স্বাধীনতার পর এবারই সম্ভবত সর্বোচ্চ নমিনেশনপত্র জমা পড়েছে। প্রায় কোনো শ্রেণি-পেশার লোক বাদ যায়নি নির্বাচন করার জন্য। তাদের আগ্রহ দেখে সাধারণ জনগণও নড়েচড়ে বসেছে। এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম একজন প্রার্থীকে বারবার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও তিনি সঠিকভাবে বলতে পারলেন না এমপির কাজ কী। তিনি এমপি হয়ে কী করবেন? সংসদে গিয়ে যে আইন প্রণেতা হিসেবে তার যে গুরুত্ব তিনি তা বুঝতেই পারছেন না। এক কথা বারবার বলছিলেন— মানুষের সেবা করব। মন্দের ভালো তবুও বলেছেন, মানুষের সেবা করব। বলেননি টাকা কামাই করতে সংসদে যাব।

এসব অষ্টম শ্রেণি, নবম শ্রেণি পাস এবং যাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে টাকার পাহাড় গড়েছেন তারা সংসদে যেতে বেশি আগ্রহী। দলগুলোও তাদেরই মনোনয়ন দিচ্ছে। তাদের তো দরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু জনগণ তো সচেতনভাবে ভালো মানুষকে ভোট দিতে আগ্রহী। যারা প্রকৃত অর্থেই দেশপ্রেমিক, দেশের জন্য কাজ করবে, সমাজে যাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে— দলগুলোর উচিত উচ্চশিক্ষিত সেসব ব্যক্তিকে নমিনেশন দেওয়া। শিক্ষিত শত্রু ভালো, অশিক্ষিত বন্ধুও ভালো নয়। জনগণকেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তার ভুল ভোটে কারো বাগানে যাতে ফুল না ফোটে। ফুল ফুটক সেইসব দেশপ্রেমিক মানুষের বাগানে যারা সারক্ষণ মানুষের জন্য কল্যাণকামী, কল্যাণ চিন্তায় বিভোর।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, হংসবলাকার ককপিটে শক্ত হাতে বৈমানিকের ভূমিকায়, ছবি দেখলাম। এরশাদ সাহেব বারবার অসুস্থতায় ন্যুব্জ। খালেদা জিয়া কারান্তরালে। মির্জা ফখরুল শক্ত হাতে ধানের শীষের মুঠি ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ তাদের ইশতেহারের ১০০ বছরের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। বিজয়ের মাসে, বছরের শেষে, কার হাসি কে হাসে। হংসবলাকায় প্রধানমন্ত্রীর হাসিমাখা মুখ। বৈমানিকের ভূমিকায় তার দেশ চালনা সামনে আরো অর্থবহ হয়ে উঠুক এ কামনা করি। তারপরও বলি, ‘এত ভালো, ভালো না’, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। ড. কামাল, কাদের সিদ্দিকী, মান্না, মনসুর— তাদের দেশপ্রেম, দেশচিন্তা জনগণকে উৎসুক করেছে— দেশের কল্যাণচিন্তায় আপনারা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যান।

লেখক : সাংবাদিক, বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads