• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
জাতীয় নির্বাচন : জনগণের লাভক্ষতি

এবারের নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষ রয়েছে শঙ্কায়

সংগৃহীত ছবি

মতামত

জাতীয় নির্বাচন : জনগণের লাভক্ষতি

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮

গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হচ্ছে গণতান্ত্রিক উৎসব, ভোটের আমেজ। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ কথাটা আমাদের দেশের জনগণের মনে আর ঠাঁই পাচ্ছে না। আমাদের দেশে নির্বাচন মানে গণতন্ত্রের সঙ্গে প্রহসন। কেন্দ্র দখল করে ব্যালট ছিনতাই, দলীয় প্রতীকে সিলমারা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং এর মধ্যে দু-একটি লাশ অতি সাধারণ ঘটনা। বিরোধীদলীয় পোলিং এজেন্ট, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া। প্রিসাইডিং অফিসার, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাজে ক্ষমতার লাগাম দেওয়া এসব আমাদের নির্বাচনের মামুলি ব্যাপার এবং আমাদের নির্বাচনী প্রথার ঘৃণ্য-ঐতিহ্য। দেশ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি নিয়ে বিশাল আকারের গলাবাজি আছে। কিন্তু এই লেখকের জানামতে, পৃথিবীতে এমন উন্নয়নশীল দেশ বিরল, যেখানে আমাদের দেশের মতো হরিলুট মার্কা নির্বাচন হয়।

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, সিলমারা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও হরিলুট মার্কা ভোট হবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ইতোমধ্যে ইসির (ইলেকশন কমিশন) পক্ষ থেকে বলে দেওয়া হয়েছে, পর্যবেক্ষকরা মূর্তির মতো থাকবেন এবং সাংবাদিকরা ভোটকেন্দ্রের ভেতরের কোনো ছবি নিতে পারবেন না। ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বরত নির্বাচনী কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমে কোনো ধরনের সাক্ষাৎকার বা বক্তব্য দিতে পারবেন না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের কর্তাব্যক্তিদের মনোভাবে সংঘাতের আলামত পাওয়া যাচ্ছে। ‘ভোটকেন্দ্র আওয়ামী লীগের দখলে থাকবে’- এটা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মহোদয়ের বাণী। অন্যদিকে কক্সবাজার-৪ আসন (উখিয়া-টেকনাফ) থেকে আরেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য ‘যারা ভোট দিবে না তাদের তালিকা দেওয়ার কথা’ বলে বাণী দিয়েছেন। এভাবে ভোটকেন্দ্র দখলের হুমকি, ভোট না দিলে তালিকা করে অ্যাকশনের হুমকি কি কোনো সভ্য দেশের সভ্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আসতে পারে? এখানে আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলকে ছোট করে কথা বলা উদ্দেশ্য নয়। মূল কথা হচ্ছে, এটা আমাদের রাজনৈতিক কালচার। মজার বিষয় হচ্ছে, ইসি (ইলেকশন কমিশন) নির্বাক প্রাণী।

গত ২ তারিখে অতীতের রেকর্ড ভেঙে ইসি ৭৮৬ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করে। মনোনয়ন বাতিল হওয়া প্রার্থীদের তালিকা দেখে মনে হচ্ছে একদলে আসমান থেকে ফেরেশতার আবির্ভাব হয়েছে আর অন্যদলে পাপী-তাপী শয়তানের ঐক্য হয়েছে। সারা দেশে মনোনয়ন বাতিল হওয়া বিভিন্ন দলের মোট ৭৮৬ জন প্রার্থীর মধ্যে বিএনপির অন্তত ৮৫ জন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বাদে (সারা দেশে ৪০টি আসনে ৭৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে; এদের মধ্যে অধিকাংশের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে) কারো মনোনয়ন বাতিল করা হয়নি। এই লেখা প্রকাশিত হতে হতে প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল নিয়ে আরো অনেক ঘটনা ঘটবে। কারো-বা প্রার্থিতা ফিরেও আসবে। প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের কারণগুলো হচ্ছে— ঋণখেলাপি, আদালতে দণ্ড, অসম্পূর্ণ মনোনয়নপত্র, স্থানীয় সরকারের পদ না ছাড়া ও হলফনামায় সই না থাকা, অনেক ক্ষেত্রে ঠিকমতো সই না থাকাসহ আরো বেশকিছু কারণ আছে। মজার বিষয় হলো, সারা দেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ২৬৮ আসনে ২৮১ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু তাদের একজন প্রার্থীও উপরোক্ত ভুলগুলো করেননি।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর গণমাধ্যমের বদৌলতে আমাদের জানা বিষয় মিথ্যা পরিণত হয়েছে। দেশের জনগণ যাদের বিলিয়ন ডলারের মালিক বলে জানত, তারাসহ অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক আসলে ‘ফকির’। কারো ঘরের আসবাবপত্র তো দূরে থাক, বাসাবাড়ি পর্যন্ত নেই। বউয়ের বাড়িতে থাকেন, বউয়ের গাড়িতে চলাফেরা করেন। সম্পত্তির মালিক বউ। প্রধান দুই দলেই এমন দেউল-প্রার্থীর নাম জানা গেছে। সময় হয়েছে বলার, তাই বলা উচিত যে, ‘পাবলিক’ অত বোকা নয়। এবারের নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হিসেবে ধরা হচ্ছে। এক দল ক্ষমতায় আসবে এবং সরকার গঠন করবে, অন্য দল থাকবে বিরোধী দলের আসনে। দেশ পরিচালনায় সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সহযোগীর ভূমিকা পালন করবে। গণতান্ত্রিক দেশে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। তাহলে এক দল ক্ষমতায় এলে অন্য দল যদি অস্তিত্বহানির শিকার হয়, এ থেকে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে- দুই দলের কেউ আমাদের দেশে গণতন্ত্র চায় না। একনায়কতন্ত্র পক্ষান্তরে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা এমন দেশ চাই না। দেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে এমন সরকারি ও বিরোধী দল কাম্য নয়।

এবার সংসদ নির্বাচনে বড় দল দুটি ক্ষমতায় এলে দেশ ও দেশের সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন ও পরিবর্তন করবে- এমনটাই বলে আসছে। কিন্তু তারা বিতর্কিত প্রার্থী, দুর্নীতি-কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত, সন্ত্রাসের মদতদাতা ও লালনকারী, মাদক ব্যবসায়ী, ঋণখেলাপির সঙ্গে জড়িত, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়ক, সিরিয়াল কিলিংয়ের সহায়তাকারীসহ অতীতে ও বর্তমানে নানা অপরাধ-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিয়েছে। এর দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়, এরা ক্ষমতায় গিয়ে দেশের কতটা উন্নয়ন করবে। এক্ষেত্রে আমাদের বড় দুটি দলের দুটি উদাহরণ আনা যেতে পরে। এক. কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্য ‘ইয়াবার গডফাদার’ আবদুর রহমান বদিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, ওই আসনে এবার বদির স্ত্রী আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দল ওই আসনে বদি পরিবারের সদস্যদের চাইতে যোগ্য প্রার্থী তৈরি করতে পারেনি, নাকি সেখানে আওয়ামী লীগ স্থানীয়ভাবে বদি পরিবারের হাতে জিম্মি? এমনই যদি হয়, আবার ক্ষমতায় এলে দিনবদলের যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, সেটা কতটা সম্ভব হবে?

দুই. চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে বিএনপির মন্ত্রী আমিনুল হক, উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা জেএমবির নেতা বাংলাভাইকে নানাভাবে মদত দিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে অনেক সমালোচিত হয়েছিলেন। ২০০৬ সালের মার্চে গ্রেফতার হওয়ার পর বাংলাভাই টিএফআই’র (টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন) কাছে জবানবন্দির সময় আমিনুল হক, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ও নাদিম মোস্তফার সহায়তার কথা স্বীকার করেছিলেন। এদের কেউ কেউ এবার মনোনয়ন পেয়েছেন। বিএনপি জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী সন্ত্রাসীর গুলিতে বাবার কোলে সন্তান নিহত হওয়ার পর ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়েছেন’ মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন। পরে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করে প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামানের হাতে পুরো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। তার সময়েই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্রপাচারের মতো ঘটনা ঘটে। খুঁজলে এরকম দৃষ্টান্ত আরো পাওয়া যাবে।

তাই বলছি, এবারের নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষ রয়েছে শঙ্কায়। তারপর রয়েছে দলগুলোর অগণতান্ত্রিক মনোভাব ও কর্ম। ইসির কার্যক্রমও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। সর্বোপরি আপাতদৃষ্টিতে দলগুলোর বিতর্কিত ব্যক্তিরাই আবার ক্ষমতায় আসছে। যে দল নিজেদের দলীয় কাঠামোর মধ্যে গুণগত উন্নয়ন করতে পারেনি, তারা ক্ষমতায় এলে দেশের আমূল পরিবর্তন ঘটবে, এটা অলীক স্বপ্ন বৈ আর কিছু নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

sadikiu099@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads