• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের পরিণতি

কয়েক মাস যাবত চলে আসছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই বাণিজ্যযুদ্ধ

সংগৃহীত ছবি

মতামত

চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধের পরিণতি

  • মো. মাঈন উদ্দিন
  • প্রকাশিত ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

বর্তমান যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। আলফ্রেড নোবেল যে ডিনামাইট তৈরি করেছিলেন উঁচু-নিচু জমি সমতল করার জন্য, সেই ডিনামাইটের সূত্র ধরে বিজ্ঞানের নব নব উৎকর্ষতায় আজকের মানুষ তৈরি করে অণু-পরমাণু অস্ত্র। কিন্তু এই মারণাস্ত্র, যা সভ্যতার বিকাশে নয়, নিজের হীন উদ্দেশ্য সাধনে সভ্যতা ধ্বংসে ব্যবহূত হতে লাগল, যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণ ও সাক্ষ্য বহন করছে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটি। এসব পরমাণু অস্ত্র মজুত করে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো এই সুন্দর ধরিত্রীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে রেখেছে। আধুনিক যুগে পরমাণু যুদ্ধ ছাড়াও যুদ্ধের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে। একেক সময় একেক নামে চলছে এই যুদ্ধ। কখনো ঠান্ডা যুদ্ধ, কখনো শীতল যুদ্ধ, কখনো মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, কখনো পরোক্ষ যুদ্ধ আবার কখনো প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশ। এমনি একটি যুদ্ধের নাম বাণিজ্য যুদ্ধ। গত কয়েক মাস যাবত চলে আসছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই বাণিজ্যযুদ্ধ। 

চীন ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের মধ্যে চলা তিক্ত বাণিজ্যযুদ্ধ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আগামী তিন মাস নতুন করে কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না বলে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। গত ১ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আয়ার্সে দেশ দুটির প্রেসিডেন্টের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনার পর এ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রামপ ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আগামী তিন মাস নতুন করে বাণিজ্য শুল্ক আরোপ না করার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন। এ সময়ের মধ্যে উভয় নেতা আলোচনা চালিয়ে যেতে চান। সম্প্রতি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনাস আয়ার্সে জি-২০ সম্মেলন শেষে উভয় দেশের দুই শীর্ষ নেতা বৈঠকে মিলিত হয়ে সামনের দিনে আরো আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হন। চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো তারা মুখোমুখি হলেন। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জি-২০ সম্মেলনে যাওয়ার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী ১ জানুয়ারি থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা আমদানি পণ্যে শুল্কের হার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করার হুমকি দিয়েছিলেন। বুয়েনাস আয়ার্সের বৈঠকের পর ওই পদক্ষেপ এখনই কার্যকর করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ। দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কৃষি, জ্বালানি, শিল্পপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলেও ভাষ্য তাদের। বাধ্যতামূলক প্রযুক্তি স্থানান্তর, মেধাস্বত্ব আইনের সংরক্ষণ, শুল্কমুক্ত বাধা, সাইবার অনুপ্রবেশ ও চুরি, কৃষি ও চাকরি খাতের অবকাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা শুরুর ক্ষেত্রেও দুই নেতা সম্মত হয়েছেন। এ লেনদেন আগামী ৯০ দিনের মধ্যে সমপন্ন হতে হবে, না হলে চীনা পণ্যের ১০ শতাংশ শুল্ক ২৫ শতাংশেই উন্নীত হবে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউজ। আর্জেন্টিনায় দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও খোলামেলা পরিবেশে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান চীনের চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই-ও। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ঘাটতি কমিয়ে আনতে নিজের দেশের বাজার ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী চীন ধারাবাহিকভাবে মার্কিন পণ্য কেনার পরিমাণ বাড়াবে বলেও জানান এ কূটনীতিক। আরোপ করা সব অতিরিক্ত শুল্ক তুলতে দুই দেশ আলোচনার গতি বাড়াবে বলেও আশা চীনা এ কর্মকর্তার। পরে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, এটি ছিল চমৎকার ও ফলপ্রসূ বৈঠক, যা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্য অসীম সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শি-র সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য বিরাট সম্মানের। ২০১৮ সালের জুলাই মাস হতে চীন-মার্কিন পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়।

যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যে ২৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের শুল্কারোপ করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন পণ্যে ১১০ বিলিয়ন ডলার শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নেয় চীন। আর্জেন্টিনায় দুই দেশের আলোচনা যদি সফল না হয় তবে বাকি ২৬৭ ডলারের চীনা পণ্যে ১০-২৫ শতাংশ বাণিজ্য শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রামপ। এশিয়ান ইকোনমিক সামিটেও বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এর আগে শনিবার জি-২০ সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা তাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানান। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মতবিরোধ সত্ত্বেও সম্মেলনে অংশ নেয়া নেতারা শেষ পর্যন্ত একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় পৌঁছতে পারায় কর্মকর্তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। চূড়ান্ত ঘোষণায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বিরোধের কথা থাকলেও সংরক্ষণবাদ নিয়ে কিছু বলা হয়নি।

এর আগে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য উত্তেজনার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেইজিং থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর নতুন করে একশ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিতে তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। মার্কিন শুল্কের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন যুক্তরাষ্ট্রের ১০৬টি গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্যে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করার পর ট্রাম্প বেইজিংয়ের ওপর চাপ বাড়াতে নতুন এ পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করছিলেন বলে খবর প্রকাশ করেছিল বিবিসি।

গত কয়েক সপ্তাহ আগে, মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে ১৩০০ চীনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের নতুন পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন। হোয়াইট হাউজের মতে, মেধাস্বত্ব অধিকার বিষয়ে চীনের অন্যায্য চর্চার কারণেই আমদানি পণ্যে এ অতিরিক্ত শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এ পরিকল্পনাকে গত বছর চীনের মেধাস্বত্ব চর্চা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের তদন্তের নির্দেশের ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার পরপরই সয়াবিন, এয়ারক্রাফটের যন্ত্রাংশ, কমলালেবুর রসসহ ১০৬টি মার্কিন রপ্তানি পণ্যে চীনের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রস্তুতির খবর পাওয়া যায়। বেইজিংয়ের এ পাল্টা পদক্ষেপকে ‘অন্যায্য’ অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেছিলেন, নিজেদের ভুল না শুধরে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষক ও কারিগরদের ক্ষতি করার পথ বেছে নিয়েছে চীন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্কের বিষয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়েরের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল চীন। পাল্টাপাল্টি এসব পদক্ষেপ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিশ্ববাজারের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তুলেছিল।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছিলেন, ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ পূর্ণমাত্রায় শুরু হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। গ্রাম্য একটি প্রবাদ আছে- কেউ মরে পাপে আর কেউ মরে তাপে। অর্থাৎ কোনো বাড়িতে আগুন লাগছে ওই বাড়ি পুড়ে ছাই হয়, সেই সঙ্গে পাশের বাড়ি না পুড়লেও এই আগুন লাগার প্রভাব যে পড়ে না তা নয়। কোনো রাষ্ট্রে যুদ্ধবিগ্রহ লাগলে তার পাশের দেশও নানান বিরূপ প্রভাবে প্রভাবিত হয়। আর সেই যুদ্ধ যদি হয় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ কোনো দেশের মধ্যে, তাহলে তো কথাই নেই। অন্যান্য দেশে তার কোনো না কোনো প্রভাব পড়বেই, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারা বিশ্ব এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর্জেন্টিনার বুয়েনাস আয়ার্সে দেশ দুটির প্রেসিডেন্টের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনার পর যে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিল তাতে অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনৈতিক রাষ্ট্রগুলো। আমরা আশা করি, এই যুদ্ধবিরতি যুদ্ধশেষের আশীর্বাদ হয়ে আসুক।

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads