• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত রুখে দেওয়ার এখনই সময়

তিরিশ লাখ মানুষের রক্তেভেজা বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত রুখে দেওয়ার এখনই সময়

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

স্বাধীনতা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না, বাঁচতে চায় না। বাঙালির জীবনে স্বাধীনতা শব্দটি আরো অনেক বেশি প্রিয়। কারণ অনেক কষ্টে পাওয়া আমাদের এই প্রিয় স্বাধীনতা। তিরিশ লাখ মানুষের রক্তেভেজা বাংলাদেশের লালসবুজ পতাকা। অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনায় আঁকা আমাদের মানচিত্র। ১৯৭১ সালে বাঙালি যখন ঝাঁপিয়ে পড়ল মুক্তির সংগ্রামে, তখন স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সক্রিয় হয়ে উঠল। পাক হানাদার বাহিনীর এই দোসররা সেদিন দেখিয়েছে বর্বরতার পরাকাষ্ঠা। ষোল ডিসেম্বর বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পরও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল দেশবিরোধী চক্র। তারা চরমপন্থা গ্রহণ করতেও দ্বিধা করেনি। সর্বহারার রাজ্য কায়েমের নামে সিরাজ সিকদার মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল। শ্রেণিশত্রু খতমের নামে তারা হত্যা করেছে কয়েক হাজার দেশপ্রেমিককে। কোনো কোনো চরমপন্থি দল ঘোষণা দিয়ে বলেছিল যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। আবদুল হকের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলের নামটি পর্যন্ত রেখে দিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। সাম্যবাদী দলও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের ষড়যন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে নিয়েছিল আরো অনেক দূর। পঁচাত্তরের পরে পল্টন ময়দানে, হতবাক হয়ে বাঙালি শুনতে পেল ‘চান-তারা পতাকা চাই’-এর মতো জঘন্য স্লোগান। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা গঠন করল ফ্রিডম পার্টি। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে পিপিআরের অধীনে গঠিত হলো শত শত রাজনৈতিক দল। এইসব ভুঁইফোঁড় পার্টির পোশাক পরে স্বাধীনতাবিরোধীরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। তৎকালীন সামরিক সরকার যতভাবে সহযোগিতা দেওয়া দরকার, তা দিয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। এরা এতটাই বেড়ে উঠেছিল যে, সরকারের অংশীদার পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। নিজামী-মুজাহিদের গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ এই দেশবিরোধীরা কিছুদিন দাঁত বের করে জাতিকে পরিহাস করতে সক্ষম হলেও, তাদের শেষরক্ষা হয়নি। স্বাধীনতার লড়াই-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নস্যাৎ হয়ে যায় তাদের দেশবিরোধী চক্রান্ত। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের ঝুলতে হয়েছে ফাঁসিকাষ্ঠে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাজা তারা পেয়েছে। পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী চরমপন্থি দেশবিরোধী দলগুলোর বেশিরভাগেরই আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। জনগণ এদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এরা নির্বাসিত, বিতাড়িত। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে যারা দেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল, তারাও সেই পথ থেকে ফিরে এসেছে, হয়তো তারা নিজেদের শুধরে নিয়েছেন। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে যারা চক্রান্ত করেছে, জনগণ তাদের প্রশ্রয় দেয়নি। বরং ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রতিহত করেছে।

রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সংগঠিত হওয়ার সব অপচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে হীনবল হয়ে গেছে, একথা সত্য। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে এরা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলেও, প্রবলভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে দাঁড়ানোর শক্তি আর এদের নেই। বাঙালি সাফল্যের সঙ্গে অপরাজনৈতিক ধারাটিকে দুর্বল অথবা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরেছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, অনেক দাম দিয়ে কেনা আমাদের স্বাধীনতার কোনো শত্রু নেই, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ আমাদের নিষ্কণ্টক হয়ে গেছে। রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতার দুশমনদের হীনবল করা সম্ভব হলেও ঘুণপোকার মতো যে বিষয়গুলো আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অর্জিত সাফল্যগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে, বাঙালির প্রাণের শক্তিটাকে হীনবল করে দিতে চাইছে, সেই শত্রুদের আমরা কিন্তু পরাজিত করতে পারিনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলো বিষাক্ত ভাইরাসের মতো জাতির সর্বনাশ করে চলেছে। জাতীয় জীবনে এক নম্বর শত্রু হয়ে দেখা দিয়েছে সর্বব্যাপী দুর্নীতি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই সর্বনাশা রোগ বাসা বেঁধেছে। এ থেকে জন্ম নিচ্ছে আরো অনেক প্রাণঘাতী সামাজিক অসুস্থতা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির বিপক্ষে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু দুর্নীতি সমূলে উৎপাটিত হওয়ার আগেই জাতির জনককে হত্যা করা হয়। তার বুকের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার শ্যামল প্রান্তর। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে সমাজের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজ ও অর্থনীতির সকল সেক্টরে দুর্নীতি ছড়িয়ে দেওয়া হয় জীবাণু অস্ত্রের মতো। পঁচাত্তর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এদেশে দুর্নীতির চর্চা চলেছে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়, বাধা-বন্ধনহীনভাবে। এমনকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে দুর্নীতিকে নিজেদের জীবনবেদ হিসেবে গ্রহণ করার দৃষ্টান্তও স্থাপন করে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী। আজ সেই দুর্নীতির আরো বহুবিস্তার ঘটেছে ঝাড়ে ও মূলে। আজ এমন একটি জায়গা নেই যেটি ঘুষ দুর্নীতিমুক্ত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সেবা কার্যক্রম আজ দুর্নীতির রাহুগ্রাসে ক্ষতবিক্ষত, বাধাগ্রস্ত। ব্যাংক সেক্টর থেকে লুটে নেওয়া হচ্ছে শতসহস্র কোটি টাকা। বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশদ্রোহীরা পাচার করে দিচ্ছে বিদেশে। দুর্নীতিবাজরা গোগ্রাসে গিলে ফেলছে দেশ-জাতির শাস-জল। সরকার ও দুর্নীতি দমন কমিশন সর্বশক্তি দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দুর্নীতিবাজদের সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। করাপশন যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। দুর্নীতির হাত ধরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঙ্গিবাদ। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো একের পর এক নিষ্ঠুর চক্রান্তে লিপ্ত। স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় আসার পর এই জঙ্গিরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে জঙ্গিবাদ অনেকটা দুর্বল হয়ে এলেও এদের চক্রান্ত থেমে নেই। ইতোপূর্বে এরা হত্যা করেছে বহু মুক্তচিন্তার মানুষকে। এরা চায় বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে। এরা বাংলাদেশকে একাত্তরের পরাজিত শক্তির পদানত করতে চায়।

অন্যদিকে তরুণসমাজকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে এনেছে মাদক। নেশার নীল দংশনে বহু তরুণ হারিয়ে ফেলেছে জীবনের শক্তি ও সাহস। এরা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধ জগতে। এসব ছেলেমেয়েদের জীবনে ও পরিবারে নেমে এসেছে নারকীয় অশান্তি। কোনো পরিবারের একটি ছেলে বা মেয়ে যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তখন পরিবারে নির্বাসিত হয়ে যায় সব শান্তি। মাদকাসক্ত সন্তানটি জীবনীশক্তি হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে ক্রমাগত। মাদক ব্যবসায়ীরা ছেলেমেয়েদের নরকের পথে চালিত করার জন্যে বাজারে নিয়ে আসছে নতুন নতুন নেশার দ্রব্য। যারা মাদক ব্যবসায় জড়িত, যারা এই বিষ ছড়াচ্ছে, নিঃসন্দেহে তারা দেশ ও জাতির শত্রু, স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ। এরাই তো আসলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি।

সরকার সবার শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে বিবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করে চলেছে। বিনামূল্যে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথম দিনই পাঠ্যপুস্তক পেয়ে যাচ্ছে। বাংলার মেয়েরা এখন শিক্ষায় অগ্রসরমান। নারীশিক্ষার হার বেড়েছে বহুগুণে। দেশে আজ আর এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে স্কুলের অভাব রয়েছে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, সরকারের মহৎ চেষ্টাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্যে অসাধুচক্র শিক্ষার মান নষ্ট করার পাঁয়তারা করে চলেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এরা আমাদের সন্তানদের নৈতিকতার ভিত নড়বড়ে করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। শিক্ষাকে কুশিক্ষায় পরিণত করে চলেছে সুকৌশলে। আসলে স্বাধীনতাবিরোধীরা, যেখানে যত ভালো কাজ হচ্ছে, সেখানেই তারা হানা দিচ্ছে, শস্যদানার পোকার মতো এরা ভালোকে মন্দে পরিণত করার চেষ্টায় লিপ্ত। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কালো টাকা ব্যবহূত হচ্ছে বাঙালির অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার জন্যে।

সব চক্রান্ত দু’পায়ে মাড়িয়ে বাংলাদেশ ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে সমৃদ্ধির পথে। আমরা ছিলাম দরিদ্র একটি দেশ। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আজ পরিচিত বিশ্বদরবারে। আমাদের মাথাপিছু আয় বহুগুণে বেড়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মর্যাদা আজ সমুন্নত। দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। জাতির এই অগ্রযাত্রা স্বাধীনতার শত্রুদের সহ্য হওয়ার কথা নয়। পরাজিত শক্তি কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছে না। ফলে তারা নানাভাবে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অগ্রসরতার পথে কাঁটা বিছিয়ে দেওয়ার জন্যে। মাদক, দুর্নীতি এবং জঙ্গিবাদকে তারা অপপ্রয়াসের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে।

আজ ডাক এসেছে দেশবিরোধী সব চক্রান্ত রুখে দেওয়ার। দুর্নীতির মূলোৎপাটন আমাদের করতে হবে। নেশার নীল দংশন থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়মের অবসান ঘটাতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে মেধাবী ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। এ জন্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের শানিত হতে হবে, সজাগ থাকতে হবে অষ্টপ্রহর। স্বাধীনতার সপক্ষের নেতৃত্বের হাত শক্তিশালী করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই এই ক্ষেত্রে। মহান বিজয় দিবসের এই স্বর্ণ সন্ধিক্ষণে আমাদের শপথ হোক জাতির জনকের সোনার বাংলা গড়ে তোলার দৃঢ় অঙ্গীকার।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশের খবর  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads