• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন

গৌবরগাঁথা মুক্তিযুদ্ধ

সংগৃহীত ছবি

মতামত

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন

  • আ. ব. ম. রবিউল ইসলাম
  • প্রকাশিত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

১৯৪৭ সালে আমরা একটি অসমাপ্ত স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে ভারতবর্ষ ভেঙে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। জনগণ সুখ ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখতে থাকে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটে; কিন্তু তার পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে শোষণ করছে পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী। বিভক্তির কিছুদিন পরেই একপক্ষ বলল, ‘ইয়া আজাদি ঝুটা হ্যায়’; অন্যপক্ষ বলে উঠল, ‘লড়কে লেংগে পাকিস্তান’। কিছুদিনের মধ্যেই এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে হতাশা দেখা দিল। মানুষ উপলব্ধি করল এই বিভক্তিতে মস্তবড় ভুল ছিল। বিশেষত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে অল্পদিনের ব্যবধানে নানা বিভেদ দেখা দিল। কী অর্থনৈতিক, কী সামাজিক, কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার বাঙালিদের নানাদিক থেকে নিপীড়ন চালাতে লাগল। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অর্থনৈতিক অঞ্চল, গুরুত্বপূর্ণ দফতর, আদালত পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ায় বাঙালিরা চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে হচ্ছিল বঞ্চিত।

পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশের বাস ছিল পূর্ব বাংলায়। কিন্তু শাসন ক্ষমতার মূল চাবিকাঠি কুক্ষিগত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। মূলত পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার জনগণ। ওরা প্রথম আঘাত হানে ভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বুকের রক্ত ঢেলে দেয় এ দেশের দামাল ছেলেরা। একুশের রক্তঝরা প্রচ্ছদে উদ্ভাসিত হয় বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীন রাষ্ট্র জয়ের স্বপ্ন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলক সামরিক শাসন জারি করে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬-দফা ঘোষণা করেন। মুক্তিপাগল বাংলার মানুষ ৬-দফাকে সাদরে গ্রহণ করল। এই ৬-দফা কর্মসূচি ছিল বাংলার কৃষক, মজুর, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তথা আপামর মানুষের মুক্তির সনদ। শুরু হয় পাকিস্তানিদের নতুন ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু জনগণের আন্দোলন-প্রতিরোধের মুখে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এরপর সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ক্ষমতা দেওয়া হয় না।  বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ লাখো মানুষের সমাবেশে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সব আলোচনা ব্যর্থ করে পাকিস্তানিরা ২৫ মার্চের কালরাতে এদেশের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করা হয়। ঢাকায় একদিনে কয়েক হাজার নিরহ মানুষকে হত্যা করা হয়। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হয় অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার। বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ ও সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে গড়ে ওঠে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। বড় বড় কয়েকটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে। খোদ আমেরিকায় মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। সেই অনুষ্ঠানে ভারতের পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।

কৃষাণ, মজুর, ছাত্র, শিক্ষক অকাতরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়ার সব ব্যবস্থা করে। সারা দেশে পাকিস্তানিরা এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি কায়েম করে। অসংখ্য নারী তাদের ইজ্জত হারায় এই যুদ্ধে। পাকিস্তানিরা পাখির মতো মানুষ হত্যা করে। তাদের হাত থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ রক্ষা পায়নি। এই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে। দেশের কলকারখানা ধ্বংস করেছে, ব্রিজ, কালভার্ট নষ্ট করেছে, লাখ লাখ বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করেছে পাকিস্তানিরা। দেশের অভ্যন্তরে পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করে। কিন্তু একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ত্বরান্বিত হয় বাংলাদেশের বিজয় অর্জন।

বিজয় দিবসের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা মিলে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে। এই দেশের আকাশ তাদেরই শেষ নিঃশ্বাসের বেদনায় নীল। এই বাংলার উদিত সূর্যে তাদেরই রক্তের নীলিমা। নদীতে নদীতে তাদেরই অশ্রুর সারাৎসার। এই বাংলাদেশ চিরকাল সেই ঘাতকদের অভিশাপ দেবে। এখনো রক্তাক্ত ক্ষতের মতো জাগ্রত একাত্তর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলে শেষ হয়নি। সেই যুদ্ধকে অব্যাহত না রাখলে আমরা সামনের দিকে এগোতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু ঘরের চৌকাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই চলবে না- একে অন্দরে নিতে হবে, অন্তরে গ্রহণ করতে হবে। চার দশক সময় অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। শেকড় প্রোথিত হয়নি।

বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম এদেশের অমিত সম্ভাবনা বাস্তবায়নে এক বিরাট অবদান রাখতে পারে। তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বড় করে তুলতে হবে। তাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা আছে তা বিকাশের সুযোগ আমাদের করে দিতে হবে। এক যোগ্য নতুন বাঙালি তরুণ প্রজন্ম অবশ্যই  বাংলাদেশকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবে। একটি শোষণমুক্ত মানবতাবাদী বৈশিষ্ট্য এদেশের সাধারণ মানুষের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি আনবে, বৈষম্য দূরীভূত হবে- এসব লক্ষ্য নিয়ে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল।

শুধু দিবস পালন নয়, মুক্তিযুদ্ধের চর্চা করতে হবে আমাদের সারাটা বছর। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কবর সংরক্ষণ করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিময় ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস তেমন কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই পার হয়ে যায়। স্কুল-কলেজে অন্তত এই দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হওয়া উচিত। এই দিনটিকে ছুটি ঘোষণা করা যেতে পারে।

একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিমাণগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সব পর্যায়ে শিক্ষার মানকে উন্নত করে তুলতে হবে। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে মেধাভিত্তিক করে আরো সক্ষম করে তুলতে হবে। আত্মঘাতী দলাদলির রাজনীতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগকে অবশ্যই তাদের নিজ নিজ বলয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। বর্তমান রাজনীতি ক্রমেই সহিংসতার দিকে চলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এ কথা সত্য যে দেশ এগিয়েছে, কিন্তু আমরা পরস্পরের সম্পর্কের দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। এটি সর্বনাশা প্রবণতা।

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু স্বাধীন রাষ্ট্রই পাইনি, কিছু মূল্যবোধের অভাবিত স্বীকৃতিও পেয়েছিলাম। এর পেছনে ছিল ১৯৪৭-এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের ধারাবাহিক তীব্র লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে মুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্যবিলোপ, বাঙালিত্ব, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। এগুলো আমাদের আগামী দিনের পথচলার অমূল্য দিকনির্দেশনা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads