• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
শহীদ বুদ্ধিজীবী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য

শহীদ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য

সংগৃহীত ছবি

মতামত

অভিমত

শহীদ বুদ্ধিজীবী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য

  • প্রকাশিত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

উত্তম কুমার পাল

হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার করগাঁও ইউনিয়নের জন্তরী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৪৫ সালের ৩১ জানুয়ারি অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য জন্মগ্রহণ করেন। বাবা স্কুলশিক্ষক দিগেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য্য এই অঞ্চলের একজন নামকরা আয়ুবের্দিক চিকিৎসক এবং মা রাজলক্ষ্মী ভট্টাচার্য্য একজন আদর্শ গৃহিণী ছিলেন। ৩ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনিই বড় ছিলেন। নবীগঞ্জ যুগল কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রয়াত সহকারী প্রধান শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন আহমেদ সহপাঠী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য সম্পর্কে বলেন, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য চলাচলে ছিল খুবই সাদাসিধে। সবসময় একটু অগোছলোভাবে থাকত। নানা বিষয়ে যুক্তি দেখিয়ে স্যারদের সঙ্গে তর্কে লেগে যেত। তখন ছিল ফাউন্টেন পেনের যুগ। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের শার্টের পকেটে সবসময় কলমের কালির দাগ থাকত। এ নিয়ে তাকে আমরা কথাও শোনাতাম। আমরা সবাই যখন স্কুলের টিউবওয়েলে পানি খেতে যেতাম, তখন অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য পানি খেত না। ওর ধারণা ছিল অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে পানি পান করা ঠিক না। আমি পুলকিত হই ওর খোলস পাল্টানো দেখে। ভার্সিটি বন্ধ, বাড়িতে এসেছে। আমার বাড়িতে এসে আমাকে বলছিল, তোরা ভালো মাংস রাঁধতে জানিস, আজ তোদের বাড়িতে খাব। ওর পরিবর্তনের কথা জানতে চাইলে অনুদ্বৈপায়ন আমাকে হেসে হেসে বলেছিল, ‘আলাউদ্দিন আগে ছিলাম ব্রাহ্মণ, এখন হয়েছি মানুষ।’

অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু তিনি ১৯৬৬ সালে বিএসসি সম্মান পরীক্ষায় পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করলেও ১৯৬৭ সালে নবপ্রতিষ্ঠিত ফলিত পদার্থ বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এর পরের বছরই ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। একই বছর তিনি জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবেও নিযুক্তি পান। পদার্থবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের তীব্রতা ছিল তার বেশি। তাই বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে গবেষণায় যেতে চেয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে বাড়িতে মা’কে চিঠিতে লেখেন, স্কলারশিপটা এবারো হলো না মা, অসুবিধা খুব বেশি। যাক, চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমার আশীর্বাদ থাকলে যত দেরিই হোক বিদেশ আমি যাবই। কেউ আঁটকাতে পারবে না। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের মেধা ও প্রজ্ঞার দরুণ বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। কলম্বো প্ল্যানের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যাওয়ার জন্য তার প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ফ্লাইটের তারিখ ও সময় নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে। তাই ২০ মার্চ অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য নবীগঞ্জে বাড়িতে এসেছিলেন মা-বাবা, ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে বলে বিদায় নিতে। দুদিন থাকেন বাড়িতে। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ সকাল ৭টার সময় মা-বাবাকে প্রণাম করে বাড়ি থেকে রওনা হন অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য। বের হওয়ার সময় দেশের পরিস্থিতির জন্য তার মা তখন যেতে মানা করেছিলেন। অনুদ্বৈপায়ন তখন বলেছিলেন, মাগো দেশের প্রধান বিদ্যাপীঠের শিক্ষক হয়েও কাপুরুষের মতো বাড়িতে থাকার জন্য তোমার অনুদ্বৈপায়নের জন্ম দাওনি। ২৫ মার্চ সকাল ৯টার দিকে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্য জগন্নাথ হলের ব্যাচেলর রুমে পৌঁছেন। ওই দিন বিকাল ৪টায় বন্ধু নির্মল মণ্ডল দেখা করতে আসেন তার সঙ্গে। সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গিয়েছিলেন বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিতে। পরদিন রাতেই স্বপ্ন পূরণের জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর কথা ছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সব তছনছ হয়ে অনুদ্বৈপায়নকে পাড়ি দিতে হলো না ফেরার দেশে।

২৬ মার্চ সকালে বুলেটের আঘাতে রুমের দরজা ভেঙে অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যকে বের করে পাকবাহিনীর জোয়ানরা। অনুদ্বৈপায়নের হাত দুটো পেছন মোড়া করে বেঁধে উপুড় করে বসিয়ে রেখেছিল এবং তার সারা শরীর রাইফেলের বাঁট-বুট দিয়ে আঘাত করতে করতে অজ্ঞান করে ফেলেছিল। পরে জগন্নাথ হলের দক্ষিণবাড়ির সামনে অন্যদের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। একই সঙ্গে নিহত হন বিখ্যাত দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবও। কিন্তু তাদের সঙ্গে থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান কালী রঞ্জন শীল। অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন জগন্নাথ হল সংসদের সাধারণ সম্পাদক পরিমল গুহ, শোভা পাল, পুস্তক বিক্রেতা ইদু মিয়া, বাসার জানালা দিয়ে দেখেছিলেন হলের গৃহশিক্ষক গোপাল কৃষ্ণ নাথ।

অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য্যের অকাল মৃত্যুতে বাঙালির সংখ্যা থেকে শুধু একজন মানুষই কমে যায়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হারায় একজন সম্ভাবনাময় মেধাবী শিক্ষা-গবেষক এবং হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জবাসী হারায় একজন বুদ্ধিজীবী কৃতী সন্তানকে।

লেখক : সাংবাদিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads