• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
শিশুরা কী শিখছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক

সংগৃহীত ছবি

মতামত

শিশুরা কী শিখছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮

বিশ্বের প্রতি দশ স্কুলশিশুর মধ্যে ছয়জন কার্যত কিছু শিখছে না; অবিশ্বাস্য এই পরিস্থিতিকে জাতিসংঘ চিহ্নিত করেছে ‘শিক্ষণ সঙ্কট’ হিসেবে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাব-সাহারান আফ্রিকা আর যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোসহ গরিব দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মনোযোগ থাকে বেশি সংখ্যায় শিশুকে স্কুলে পাঠানোর দিকে। কিন্তু ওই শিশুদের একটি বড় অংশ যে শিক্ষার ন্যূনতম মানে পৌঁছাতে পারছে না, তা উঠে এসেছে ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকসের সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাতশ কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে ৬০ কোটির বেশি স্কুলপড়ুয়া শিশু সাধারণ গাণিতিক সমস্যার সমাধান, এমনকি ঠিকমতো পড়তে পারার দক্ষতাও অর্জন করতে পারছে না। সাব-সাহারান আফ্রিকায় ৮৮ শতাংশ শিশু-কিশোর ঠিকমতো পড়তে পারার দক্ষতা ছাড়াই প্রাপ্তবয়স্কের জীবনে প্রবেশ করছে। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ৮১ শতাংশ শিশু ঠিকমতো সাক্ষরতা অর্জনের আগেই স্কুল শেষ করছে। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকস সতর্ক করে বলেছে, এ পরিস্থিতিতে যে কোনো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে যেতে পারে। শিক্ষায় বৈষম্যের এই ভয়াবহ চিত্র দেখিয়ে ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিসটিকসের পরিচালক সিলভিয়া মনতৈয়া বলেন, এমন নয় যে এই শিশুরা সরকারের সুবিধা বা সামাজিক আওতার বাইরে। তারা স্কুলে যাচ্ছে। শিক্ষার মান বাড়াতে আমাদের যে আরো বিনিয়োগ করা প্রয়োজন, এই গবেষণা সে কথাই বলছে। স্কুলপড়ুয়াদের শিখতে না পাড়ার এই সঙ্কট বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার এই ব্যর্থতা বিশ্বে একই সঙ্গে নৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে কোটি কোটি কিশোর তরুণ যে নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে তারা নিম্ন আয়ের নিরাপত্তাহীন এক কাজের বাজারে আটকা পড়ছে। কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা, নিকারাগুয়ার মতো দেশে কয়েক বছর স্কুলে যাওয়ার পরও শিশুরা সাধারণ অঙ্ক করতে পারছে না বা শুদ্ধভাবে পড়তে ব্যর্থ হচ্ছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে অল্প বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া শিক্ষার্থীর হার ১৪ শতাংশের মতো। কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বে যত শিশু স্কুলে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ এসব উন্নত দেশের বাসিন্দা।

গবেষকরা তাদের জরিপে যখন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের 'The name of my dog is Puppy' ইংরেজিতে কিংবা সোয়াহিলিতে পড়তে বললেন, তিন-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থীই বুঝতে পারেনি ওই বাক্যের মানে কী। ৪৬ থেকে ১৭ বিয়োগ করলে কত হয়— এই অঙ্কের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া তিন-চতুর্থাংশ শিশু। আর পঞ্চম শ্রেণির অর্ধেক শিক্ষার্থী ওই অঙ্ক মেলাতে পারেনি। জাপানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যেখানে ৯৯ শতাংশ শিশু লেখাপড়ায় ন্যূনতম মান উতরে যেতে পারছে, সেখানে মালিতে সেই দক্ষতা দেখাতে পারছে মাত্র ৭ শতাংশ শিশু। গবেষকরা বলছেন, আফ্রিকার তুলনায় ব্রাজিলের শিশুরা তুলনামূলক ভালো মানের শিক্ষা পেলেও যে গতিতে সেখানে শিক্ষার মান এগোচ্ছে তাতে গণিতের দক্ষতায় উন্নত দেশের গড় মানে পৌঁছাতে তাদের লাগবে ৭৫ বছর।

বৈষম্য আছে বিত্তশ্রেণিতেও। ক্যামেরুনে প্রাইমারি শেষ করা মেয়েদের মধ্যে যারা গরিব ঘরের সন্তান, তাদের মাত্র ৫ শতাংশ মাধ্যমিকে ভর্তির সুযোগ পায়। অথচ ধনী পরিবারের মেয়েদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ এই সুযোগ পেয়ে থাকে। বিশ্ব্যাংকের এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরিদ্র দেশগুলোতে বহু শিশু স্কুলে যাচ্ছে, যেখানে শেখার পরিবেশ নেই। বাংলাদেশ, গাম্বিয়া, রোমানিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে তাদের মস্তিষ্কের গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রেও তারতম্য দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা। কোনো কোনো দেশের স্কুলপড়ুয়া শিশুরা এতটাই দারিদ্র্য ও অপুষ্টির শিকার যে, তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে তারা শিখতে পারছে না। ঘাটতি রয়েছে শিক্ষাদানের মানেও। গবেষকরা বলছেন, যারা স্কুলে পড়াচ্ছেন তারা সবাই মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত নন। আবার আফ্রিকার অনেক দেশে শিক্ষকরা ঠিকমতো স্কুলে যান না, কারণ তারা নিয়মিত বেতন পান না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে কি-না তা দেখার ব্যবস্থা নেই বহু দেশে। অনেক জায়গায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ফলাফল নিয়ে মৌলিক তথ্য পাওয়াই কঠিন।

উন্নত দেশগুলোতে যেখানে শিশুদের পরীক্ষার চাপ বেশি হয়ে যাচ্ছে কি-না সেই বিতর্ক উঠেছে, সেখানে গরিব দেশগুলোতে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে সামান্যই। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার বলেন, স্কুলপড়ুয়া বহু শিশু যে আজ বলার মতো কিছুই শিখছে না, তা স্বীকার করে নিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এই নির্মম সত্য মেনে নিলে তারপরেই আমরা উন্নতির কথা ভাবতে পারব।

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক। তার ওপর বিনামূল্যে বই পাচ্ছে সব শিক্ষার্থী। ৯৭ শতাংশ শিশু আজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। বিষয়গুলো সবই পজিটিভ কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা কী শিখছে, সে বিষয়ে মাঝে মাঝে দু-একটি গবেষণা হয় এবং তাতে দেখা যায় অবস্থা ভয়াবহ। জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংক প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যে বৈশ্বিক চিত্র প্রদর্শন করেছে, আমাদের অবস্থা কিন্তু তার চেয়ে ভালো নয়। আরো সমস্যা রয়ে গেছে, একটি শিশু যখন হাওর কিংবা পাহাড়ি এলাকার কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে, তখন তার সঙ্গে শহরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর সব বিষয়ের মানে একটি বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আবার যারা ঢাকাসহ বড় বড় সিটির কিন্ডারগার্টেনে পড়ছে, তাদের মধ্যে মানগত তফাত থেকে যাচ্ছে অনেক। এর প্রমাণ আমরা পাই, যখন দেখি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী চলতি বছরের মার্চ মাসের দিকে শেরপুর থেকে ফেরার পথে বড় রাস্তার ধারে হঠাৎ একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন এবং চতুর্থ শ্রেণিতে ঢুকে কথাবার্তা বলার পর জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমরা কি কেউ ফোর বানান লিখতে পার? আমাদের দুর্ভাগ্য যে, কেউ পারেনি। এই একটি চিত্রই বলে দেয় আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা কী শেখাচ্ছি। এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

masumbillah65@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads