• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক

  • প্রকাশিত ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

আমাদের দেশে পাকিস্তান আমল থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং কার্যক্রম রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সেটা মোটামুটি বলবৎ থাকলেও পরবর্তী সময়ে ওই কার্যক্রম ক্রমেই স্থবির হয়ে যায়। ভারতে কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণের সক্রিয় ও ব্যাপক কার্যক্রমের ইতিবাচক প্রভাবে সেখানকার সব শ্রেণির মানুষের ওপর প্রবল প্রভাব ফেলেছিল। তাদের মধ্যে সেই সচেতনতার সুফল ঘরে ঘরে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পৌঁছে গেছে। সে কারণে পশ্চিম বাংলায় প্রতিটি পরিবারে একটি বড়জোর দুটির অধিক সন্তান কারো নেই। কলকাতাসহ কলকাতার শহরতলি এবং জেলাগুলোয় প্রতিটি পরিবারে এটি দৃশ্যমান।

আমাদের এখানে তো যৌথ পরিবার ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও টিকে আছে। পশ্চিম বাংলায় যৌথ পরিবার বহু আগেই ভেঙে গেছে। সেখানে পরিবার মাত্রই ব্যক্তি এবং তার স্ত্রী-সন্তানরা। এর বাইরে ভাই-বোনরা তো পরের কথা, বাবা-মায়েরা পর্যন্ত পরিবারভুক্ত নয়। তারা সন্তানদের সঙ্গে একত্রে থাকার অধিকার হারিয়েছে। বয়ঃবৃদ্ধ বাবা-মায়েরা শত প্রতিকূলতায় পৃথক বসবাস করছেন। বিয়ের পর সন্তানরা পিতা-মাতার দায়-দায়িত্ব উপেক্ষা করে একত্রে বসবাস করে না। স্ত্রীর তাগিদে বা চাপে বাধ্য হয় তাৎক্ষণিক পৃথক হতে। ব্যতিক্রম থাকলেও সেটা অতি নগণ্য। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার প্রভাব সেখানে এতটাই সক্রিয় যে, সেসব ঘটনা দেখে-শুনে আমাদের হতবাক হতে হয়। আমাদের এখানেও তার প্রভাব ক্রমান্বয়ে পড়ছে বটে, তবে অত ব্যাপক আকারে এখনো বিস্তার লাভ করেনি। আমাদের এখানে বিত্তবান শ্রেণির সন্তানরা বিদেশে থাকায় তাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের শেষ আশ্রয় বৃদ্ধাশ্রম। বিত্তহীনদের তো দুরবস্থার অন্ত নেই। চলতি বছর বেশ ক’বার কলকাতায় যাওয়া হয়েছিল। কলকাতাসহ বিভিন্ন জেলায়ও গিয়েছিলাম। সর্বত্রই একই দৃশ্য। বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা সন্তানহীন দুর্বিষহ একাকিত্ব প্রবল প্রতিকূলতায় জীবন সায়াহ্নের সময়গুলো পার করছেন।

এবার আমার ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা মো. জয়নাল আবেদীন। বিক্রমপুরের ক’জন পশ্চিমবঙ্গবাসী পরিচিতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি সাক্ষাৎ করেছেন। তারা সবাই জয়নাল ভাইয়ের থেকে বয়সে আট-দশ বছরের বড়। প্রত্যেকের বাসায় গিয়ে দেখি প্রৌঢ়ত্বের শেষসীমায় থাকা স্বামী-স্ত্রীতে বসবাস করছে। দুজনে মিলেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরকন্না করছেন। অসুস্থ স্ত্রী কিংবা স্বামীর সেবা-শুশ্রূষার পাশাপাশি ঘরকন্নার কাজেও ব্যস্ত দেখেছি। তাদের সবারই এক বা দুই সন্তানের অধিক সন্তানাদি নেই। প্রায় সবারই এক ছেলে কিংবা এক ছেলে-এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের বিয়ের আগপর্যন্ত একমাত্র ছেলেকে নিয়েই ছিল তাদের সংসার। ছেলে যেমন সংসার চালানোর দায়িত্ব পালন করত, পাশাপাশি সংসারের সামগ্রিক কাজও তদারকি করত। ছেলের বিয়ে উপলক্ষে ছেলের জন্য বাবা-মায়েরা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা উপযোগী ঘর নির্মাণ করেছেন, যাতে যুগোপযোগী আধুনিক আবাসে বউমার কষ্ট না হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি বাবা-মা-ই নিজেদের সঞ্চিত সব অর্থ এবং রাষ্ট্রীয় ঋণদান সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ছেলের আবাসন পরিপাটি করে দিয়েছেন। কিন্তু বিধিবাম। ছেলের বিয়ের ছয় মাস-এক বছরের মাথায় বউমার প্ররোচনায়, জেদ ও কৌশলে ছেলেকে নিয়ে দূরের ভাড়া বাসায় কিংবা ক্রয় করা ফ্ল্যাটে বাবা-মাকে একলা ফেলে চলে যাওয়ার অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বৃদ্ধ বয়সে রেশন তোলা, বাজার করা, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাসের সিলিন্ডার আনা, সেবা খাতের বিল পরিশোধসহ সামগ্রিক কর্মযজ্ঞ অসহায় বৃদ্ধ পিতাকেই করতে হয়। পিতা অসুস্থ থাকলে মাকেই বাধ্য হয়ে সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়। তাদের সেই কষ্টকর অমানবিক জীবন-যাপন দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি কলকাতায়।

নদীয়ার ফুলিয়ায় গিয়েও দেখেছি আমাদের কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্তের পরিবারের অভিন্ন দশা। রোগেভুগে বার্ধক্যে হরিপদ দাদা নিরুপায়ে দেশ ছেড়ে পরিবারের কাছে ফিরে গেছেন ক’বছর আগে। তার পরিবার সেখানে থাকলেও তিনি ভিসা নিয়ে বছরে দু-তিনবার পরিবারকে দেখতে যেতেন। শেষে নিরুপায় হয়ে স্থায়ীভাবে চলে যান। বাংলাদেশে সাহিত্যিক হিসেবে তিনি খ্যাতিবান। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক হরিপদ দত্ত এখন গ্রাম-মফস্বল ফুলিয়ায় সামাজিক জীবন বিচ্ছিন্ন একজন অতি-সাধারণ মানুষ মাত্র। সেখানে তার কোনো সামাজিক জীবন নেই। তাকে পরিবারের সব কাজকর্মে ব্যস্ত জীবন কাটাতে হয়। সেখানকার পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি তো পরের কথা, তিনি যে সাহিত্যিক এই পরিচয়টুকুও পর্যন্ত কেউ জানে না। পূর্ববাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রত্যাগতরা পশ্চিম বাংলার সাহিত্য-সমাজে পুরোপুরি ব্রাত্য। হরিপদ দাদার একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তিনি স্বামীর সঙ্গে বহরমপুরে থাকেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন। একমাত্র ছেলে, তিনিও পিএইচডি সম্পন্ন করে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত। ক’বছর আগে কৃষ্ণনগর থেকে পারিবারিক উদ্যোগে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন। বউমাও সরকারি স্কুলের শিক্ষক। ছেলের বিয়ের আগে ধারদেনা করে একতলা বাড়িতে দোতলা তুলেছেন। অত্যাধুনিক সেই দোতলায় বিয়ের পর ছেলে ও বউমা বসবাস করতেন। এখানেও বিধিবাম। মাত্র এক বছরের মাথায় কৌশলী অজুহাতে বউমা স্বামীকে নিয়ে কৃষ্ণনগর চলে গেলেন। এখন প্রৌঢ়ত্বের কিনারে থাকা হরিপদ দাদা ও বউদি মিলে কষ্টে-সৃষ্টে জীবনের অবশিষ্ট সময় পার করছেন। গভীর দুঃখে হরিপদ দাদার স্ত্রী আমাকে বলেছেন, ‘ছেলেকে জন্ম দিলাম, পরম স্নেহে মানুষ করে তুললাম। আপনার দাদা তো ঢাকায়। আমি একা সন্তান দুটিকে সমাজে যোগ্যরূপে গড়ে তোলার পর যখন বউমা বলেন, আমরা নাকি আমাদের কর্তব্য করেছি, যেটা সব বাবা-মা-ই করে থাকেন। কিন্তু বিয়ের পর স্বামী একান্তই স্ত্রীর, অন্য কারো নয়। স্বামীর প্রতি সব অধিকার একমাত্র স্ত্রীরই। আরো বলেছে, ‘অকারণে মায়াকান্না করে আমার স্বামীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন না।’ ছেলে চলে যাওয়ার পর থেকে বউদি প্রচণ্ড রকম ভেঙে পড়েছেন। তবে হরিপদ দাদা বাস্তবতা মেনে স্ত্রীর পাশে থেকে সংসারের যাবতীয় কর্তব্য করে যাচ্ছেন।

জয়নাল ভাইয়ের অগ্রজপ্রতীম বিক্রমপুরের ফটিক দে’র নিউ আলীপুরের বাসায় গিয়েছিলাম। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে মওলানা ভাসানীর সংগঠনে সক্রিয়ভাবে যুক্ততার কারণে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর পালিয়ে কলকাতায় চলে যান, তুখোড় ফুটবলার ফটিক দে। দেশে না ফিরে সেখানেই স্থায়ী হয়ে গেছেন। সরকারি চাকরি করতেন। এখন অবসরে। নিউ আলীপুরে পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট কিনে একত্রে একটি বড় ফ্ল্যাট করে সেখানেই স্বামী-স্ত্রী বসবাস করছেন। তার বাসা চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল, তাকে ফোন করলে তিনি নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়াতে বলে প্রায় ছুটে এসে আমাদের দোতলার ফ্ল্যাটে নিয়ে ওঠেন। ঘরে ঢোকামাত্র গৃহকর্মী বলে ওঠে, ‘জল নেই, জল ছেড়ে আসো।’ ফটিক দে আমাদের ঘরে ঢুকিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে গেলেন জল ওঠানোর মেশিন ছাড়তে। অল্প পরেই ফিরে এলেন। ওই গৃহকর্মীর ওপর অধিক নির্ভরশীলতার সুযোগেই গৃহকর্মীটি আদেশের সুরে তাকে জল তোলার নির্দেশ দিতে পেরেছে। তার স্ত্রী অসুস্থ। এক মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে স্বামীর সংসারে আর ছেলে বিয়ের পর যৌথ পরিবার ত্যাগ করে স্ত্রীকে নিয়ে পৃথক স্থানে বসবাস করছে। ছেলে এবং বউমাকে নিয়ে একত্রে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন, সে আশায় দুটি ফ্ল্যাটকে একত্র করে বড় একটি ফ্ল্যাট করেছিলেন। অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে, ডাক্তারের কাছে তাকেই ছুটতে হয়। সংসারের সব কাজ নিজেই করেন। এমনকি রান্নার কাজও। গৃহকর্মীটি কেবল ঘরমোছা, কাপড় ধোয়া, থালা-বাসন পরিষ্কারের কাজ করে। বাকি সব কাজ তাকেই এই বৃদ্ধ বয়সে করতে হয়। ছেলের প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেছিলাম। ছেলের প্রশংসা করলেও বিয়ের পর ছেলের ওপর আর তাদের অধিকার থাকেনি। বউমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছেলের কিছুই করার জো-টি নেই। তাই আক্ষেপে ফটিক দাদা বলেছেন, “আমাদের পশ্চিম বাংলার সিংহভাগ ছেলেই ‘পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক’।”

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads