• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
হিরো আলমের সংসদ নির্বাচন

সংসদ নির্বাচন

প্রতীকী ছবি

মতামত

হিরো আলমের সংসদ নির্বাচন

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

হিরো আলম জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন, পাননি। এরপর তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। বাছাইতে রিটার্ন অফিসার তার মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন। নির্বাচন কমিশনে আপিল করেও তিনি প্রার্থিতা ফিরে পাননি। কিন্তু থেমে যাওয়ার পাত্র নন এই হিরো। তিনি হাইকোর্টে রিট করেছিলেন প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার জন্য। বিফল স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী ঐক্য পরিষদ’ আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সেও বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। বলেছেন তার কিছু ক্ষোভের কথা।

হিরো আলম নির্বাচন করবেন-এই ঘোষণার পর থেকেই তাকে নিয়ে শুরু হয়েছিল আলোচনা। এবার অনেক সেলিব্রেটি মনোনয়ন ফর্ম কিনেছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফর্ম কিনেছিলেন ক্রিকেট তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজা, আসাদুজ্জামান নূর, কবরী, মমতাজ, তারানা হালিম, ফারুক, শমী কায়সার, রোকয়া প্রাচী, শাকিল খান, ডিপজল প্রমুখ। বিএনপি থেকে কনকচাঁপা, বেবী নাজনীন, হেলাল খান। ডাকসাইটে আমলা ড. ফরাস উদ্দিন মনোনয়ন ফর্ম কিনেছিলেন, ফর্ম কিনেছিলেন বিশিষ্ট চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত আর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা ড. মাসুক পথিকসহ আরো অনেকে। তাদের কেউ মনোনয়ন পেয়েছেন, কেউ পাননি। কিন্তু সবাইকে হারিয়ে আলোচনার দৌড়ে ছিলেন হিরো আলম আর মাশরাফি।

তবে অন্যদের থেকে হিরো আলমকে নিয়ে আলোচনার ধরনটা ছিল অনেকটাই আলাদা আর নেতিবাচক। তার নামের আগে হিরো তিনি নিজে বসিয়েছেন বা অন্য কেউ, আমার জানা নেই। তবে সবাই বলছে তিনি ‘জিরো থেকে হিরো’ হয়েছেন। আচ্ছা জিরো থেকে হিরো হওয়া কি অপরাধ? তিনি ভিক্ষা করতেন, সৎ পিতার ঘরে বেড়ে উঠেছেন, আগে চানাচুর বেচতেন। তারপর ডিশ ব্যবসা, সবশেষে মিউজিক ভিডিও। তাতে অসুবিধা কী? তিনি তো কিছুই অস্বীকার করেননি বা লুকাননি। তিনি দেখতে খারাপ, ক্লাস সেভেন পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন না, এই তো! আমাদের এই সংসদে অনেকে আছেন যারা স্বশিক্ষিত। এমন কোনো শর্ত আছে কি যে সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে গেলে নায়কের মতো চেহারা হতে হবে? আর শুদ্ধ ভাষা, এই মহান জাতীয় সংসদে ক’জন আছেন যারা চমৎকার পরিশীলিত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন? যে এলাকার মানুষ সে এলাকার ভাষায় কথা বলাই তো শ্রেয়, আন্তরিকতার প্রকাশ। সোনার চামচ মুখে নিয়ে না জন্মে নিজে কষ্ট করে, খেটে যেটুকু করেছেন সেটুকু হিরো আলমের পুরো অর্জন। এ কৃতিত্বের ভাগ কারো নেই।

বগুড়া সদরের এরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা হিরো আলাম। প্রকৃত নাম আশরাফুল ইসলাম আলম। হিরো আলম সরল সহজ সাদাসিধে। ডিশ ব্যবসা করতে করতে মিউজিক লাইনে কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করায় তিনি অনেকগুলো মিউজিক ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছেড়েছেন। সেগুলোতে তিনি নিজে অভিনয় করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। সেগুলো ভালো বা মন্দ তা জানি না। তবে জানি, তার ফলোয়ার তিন লাখের উপরে আর ‘সুলতান’ ও ‘দাবাং’ খ্যাত তারকা সালমান খানের চেয়েও বেশিবার তাকে গুগলে সার্চ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে হিরো আলম বাংলাদেশের ‘মার ছক্কা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বলিউডের পরিচালক প্রভাত কুমারের ‘বিজু দ্য হিরো’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি।

তিনি বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। আগে দুবার ইউপি নির্বাচন করে অল্প ভোটে হেরেছেন। এলাকার লোককে কথা দিয়েছিলেন। ‘কথা দিলে কথা রাখতে হয়’ তাই এবার তিনি সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াতে চান। কথা দিলে কথা রাখতে হয়— এ কথা আমাদের ক’জন লেখাপড়া জানা ভালো চেহারার সংসদ সদস্য মানেন?

নির্বাচন করবেন এ ঘোষণা দেওয়ার পর, সাক্ষাৎকারের নামে টিভিতে ডেকে তাকে উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন করে অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে যারা অপমান করতে চাইছিলেন, তাদেরই ঘায়েল করেছেন হিরো আলম। স্পষ্ট বলেছেন, ‘আমি যদি যোগ্য না হই, আমাকে ডেকেছেন কেন? নরেন্দ্র মোদি যদি চায়ের দোকানদার থেকে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন আমি পারব না কেন? আমি যেখানে এসেছি সেখানে কে এনেছে? আমি নিজে।’ প্রবল আত্মবিশ্বাসী আলমকে অনেক ট্রল করে, অনেক অপদস্থ করার চেষ্টা করেও ঠকাতে পারেননি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী, বরং নিজেই ঠকে গেছেন।

কত চোর-লুটেরা-বাটপাড়, ছিনতাইকারী, ঋণখেলাপি, পরিবহন ব্যবসায়ী, নির্বাচন ফর্ম কেনে, দাঁড়ায়, জেতে। হিরো তো ঋণ নেননি, চুরি-ডাকাতি-বাটপাড়ি, হোটেল ব্যবসা, রয়ালপার্ক, পরিবহন ব্যবসা, দালালি-তদবিরবাজি কিছুই করেননি। নিজে খেটে এতটা এসেছেন। আমাদের সংসদ সদস্যদের পুত্ররা মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরে ফেলে, পরিবহন চালানো বন্ধ করায়, অ্যাম্বুলেন্সে মানুষ মারা যায়, নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে— এমন আরো কত কেচ্ছা। তারপরও তারা নমস্য। তাদের গদিচ্যুতি ঘটে না, সদর্পে স্ব-মহিমায় তারা চলেন বলেন করেন। আর যত দোষ গরিবের ছেলে হিরো আলমের। অবশ্য চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস হিরো আলমকে সমর্থন করেছেন। সমর্থন করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন শাহনাজ গাজী নামে একজন কূটনীতিক। বড্ড ভালো লেগেছে তার চেতনার জায়গাটা দেখে।

হিরো আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে এলাকার যে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দিয়েছিলেন তার মধ্যে ভুয়া পাওয়া গেছে এই অভিযোগে। হিরো আলম দাবি করেছেন, মনোনয়নপত্রের সঙ্গে এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সঠিকভাবে দেওয়ার পরও সামাজিক বাস্তবতার কারণে নির্বাচন কমিশনে আপিলে তা প্রমাণ করতে পারেননি। সামাজিক বাস্তবতার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার এলাকায় ভোটার ৩ লাখ ১২ হাজার। আমার ৩১০০ ভোটারের স্বাক্ষর লাগে। আমি ৩৫০০ দিয়েছি। তারপরও বাতিল হয়েছে। গ্রামগঞ্জের লোক তো এমনিতেই ভয় পায়। সত্য কথা বললে তো লাশ হতে হয়, জেলখানায় যেতে হয়, না হয় এলাকা ছাড়তে হয়। তাই যাচাইয়ে আমার কথা বলেনি।’

হিরো আলম আরো বলেছেন, ‘জনগণের এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি কারো ওপরেই কোনো আস্থা নেই। তারা চায় স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী যাতে নির্বাচন না করতে পারে, সেজন্য এ নিয়ম করা হয়েছে। আমরা জনগণ চাইলে হিরোকে জিরো করতে পারি। জনগণ এক হতে পারি না বলেই এই সমস্যা।’ আপিল খারিজ হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হিরো আলম বলেছিলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। রাজারা চায় না প্রজারা রাজা হোক। এমপি-মন্ত্রীরা চান না আমরা পাবলিক এমপি-মন্ত্রী হই। তারা সবসময় চান তাদের বউ, ছেলে-মেয়ে, উত্তরাধিকারীরা এমপি-মন্ত্রী হোক।’

আরপিও সংশোধন করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রে এলাকার এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমাদানের নিয়ম করেছে নির্বাচন কমিশন। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিধানটি গেজেট আকারে প্রকাশ করে কমিশন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন অনেক লোক দলীয় মনোনয়ন পান যারা জীবনে কোনোদিন এলাকায় যাননি। এলাকার লোক তাদের চেনে না। এলাকায় তাদের ঘরবাড়িও নেই। এমন লোকও দলীয় মনোনয়ন পান, যাদের জামানত ন্যক্কারজনকভাবে বাজেয়াপ্ত হয়। এলাকার এক শতাংশ তো দূর, ২০-২৫টি ভোট হয়তো পান। তাদের ক্ষেত্রে আইনের কোনো কড়াকড়ি নেই। তাহলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এমন কী অপরাধ করল, যাতে তাদের জন্য এক শতাংশ স্বাক্ষরের বাধ্য বাধকতা! ভোট দেওয়া, ভোটে অংশ নেওয়া জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যায় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের আইন থাকাও ঠিক নয়। যেখানে এক ব্যক্তি তিনটি আসনে পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে, সেখানে স্বাক্ষর সংগ্রহের এই বাধ্যবাধকতা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনের পথে একটা বড় বাধা। নির্বাচন কমিশন চাইলে তাদের নির্বাচনী ফি বাড়াতে পারে কিন্তু এ ধরনের আইন সত্যিই প্রশংসাযোগ্য নয়।

হিরো আলম হাইকোর্ট থেকে তার প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। কোর্ট তাকে প্রতীক বরাদ্দের জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশও দিয়েছেন। আলমের বিপক্ষে রয়েছে প্রধান দুই দলের শক্তিশালী প্রার্থী। তারপরও এতটুকু নিরাশ নন এই হিরো। তিনি বলেছেন, ‘জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি এগিয়ে। জনগণ মার্কা দেখে নয়, প্রার্থী দেখে ভোট দেবে।’ 

হিরো আলম জিতবে কি জিতবে না, জানি না। তবে তার কিছু কিছু কথা সত্যিই মনে গেঁথে যায়। সেজন্য তাকে প্রশংসা করি। আমাদের এই মহান সংসদে সত্যিকার সৎ যোগ্য সাহসী মানুষ আসা দরকার- যারা সাহস করে সত্য কথা বলবেন। নিজের স্বার্থের জন্য নয়, জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads