• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

খেলনা যুগ

  • মাসুদ কামাল হিন্দোল
  • প্রকাশিত ২১ ডিসেম্বর ২০১৮

যুগের পর যুগ এসেছে। অনেক অনেক যুগ। সে সব যুগের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। পৃৃথিবী পার করে দিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পাথর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, হিমযুগ, প্রস্তর যুগ, তাম্রযুগ, লৌহযুগ ইত্যাদি। আধুনিক কালে এসেছে প্রযুক্তির যুগ, রোবট যুগ। প্রযুক্তির যুগের মধ্যেও এসে গেছে অনেক যুগ। যুগের ভেতরে যুগ। একটা যুগের ভেতরে আরেকটা যুগের অনুপ্রবেশ। আধুনিক প্রযুক্তির যুগ। কম্পিউটার ইন্টারনেটের পর এসে গেছে হাইটেকের যুগ। হাই, হ্যালোর যুগ। সেলফোনের যুগ, ফোর-জির যুগ। এসব নানাবিধ যুগের শেষে মানবজাতি এখন এসে পৌঁছেছে খেলনা যুগে। খেলনা যুগের সবকিছুই খেলনা।

খেলনা যুগের সবকিছু একবার ব্যবহারযোগ্য। এক্ষেত্রে প্রেমিকা বা প্রেমিক তার জন্য ওয়ান টাইম। জামা-কাপড় বদলানোর মতোই। এ ছাড়া টিস্যুপেপার, হালকা উপন্যাস, নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা, গান, কবিতা, বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, সিডি, ভিসিডি যাবতীয় বিষয় এবং বস্তু মাত্র একবারই ব্যবহার করা যায়। বলপেন কলমের মতো ফুরিয়ে গেলেই শেষ। এখন প্রেম হয় না প্রেমের মতো। ভালোবাসা ঘনীভূত হয়ে প্রেমের জন্ম হয় না। প্রেমিক ভালোবাসতে বাসতে প্রেমিকার সর্বস্ব লুট করে নেয়। আর প্রেমিকা ভালোবাসতে বাসতে প্রেমিককে ফতুর করে দেয়। খেলনা যুগের ছোঁয়ায় আধুনিক কবিদের কবিতাও বদলে গেছে, ‘তোমার ওপর ছিল আমার আস্থা, এখন দেখি তুমি যে খুব সস্তা।’ চলুন পাঠক, খেলনা যুগের কিছু খেলনা অনুগল্প শোনা যাক—

এক. ঘটনাটি জর্ডানের রাজধানী আম্মানের। আদনান ও জামিলা দুই ভিন্ন ইন্টারনেট চ্যাট রুমে বসে ভিন্ন নামে কয়েক মাস ধরে পরস্পর চ্যাট করছিলেন। জামিলা নিজেকে সংস্কৃতিমনা, অবিবাহিত বলে পরিচয় দেন। তিন মাসের চ্যাটেই দুজনার মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। শেষে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন দুজনে। জারকার এক বাস ডিপোতে প্রথমবারের মতো দেখা হবে দুজনার। দুজনার মাঝে মৃদু উত্তেজনা। রোমান্টিক মুডে অপেক্ষমাণ আদনান। সামনে এসে দাঁড়ালো কাঙ্ক্ষিত জামিলা। কিন্তু একি! এ তো তারই স্ত্রী সানা।  জামিলারূপী সানা দেখলেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তারই স্বামী আদনানরূপী বকর মেলহেম। দুজনেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। ক্রুদ্ধ বকর তৎক্ষণাৎ সানাকে তালাক দেন। ভেঙে গেল তাদের সুখের সংসার।

দুই. বিয়ের মাত্র ৯০ মিনিটের মধ্যে বুঝে গেলেন তারা একে অপরের জন্য নয়। দাম্পত্য জীবনের কলহ এমন একপর্যায়ে পৌঁছে যে, পুলিশকে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হয়। বর এখন শ্বশুরবাড়িতে মানে জেলখানায়। লন্ডনের দ্য সান পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিয়ের এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই লন্ডনের একটি পানশালায় কলহের সূত্রপাত ঘটে। অতিরিক্ত মদ্যপানে মাতাল হয়ে বর নববধূর সঙ্গী মেয়েদের হাতে মদ পান করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারেননি নববধূ। ক্ষিপ্ত হয়ে স্বামীর মাথায় আঘাত করলে স্বামী টেবিলের ওপর লাফিয়ে উঠে হাতের কাছে যা পাচ্ছিলেন তা-ই ছুড়ে মারছিলেন। পানশালা কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ বরকে গ্রেফতার করে। সে রাতে তাকে জেলেই কাটাতে হয়েছে। আদালত তাকে  ৯০ ঘণ্টার গৃহবন্দির আদেশ দিয়েছেন। নববধূ চেয়েছেন তালাক। স্বামী বলেন, ‘এমন মহিলার কবল থেকে মুক্ত হতে পেরে আমি খুশি, আমার বিয়ের দিনটি আমার জন্য এক দুঃস্বপ্ন’।

তিন. ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিজনৌ জেলার কারোন্ডা পাচদু গ্রামে কারি ইমরান বরযাত্রীসহ বিয়ে করতে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্ডগোলের সূত্রপাত। মেয়ের বাড়ির লোকজন অভিযোগ করেন, বিয়েবাড়ির একটি আলমারি থেকে নগদ প্রায় দেড় লাখ টাকা ও অলঙ্কার চুরি হয়ে যায়। মেয়ের বাড়ির সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে বরের সঙ্গে আসা দুই আত্মীয়ের দিকে। এ নিয়ে দু’পক্ষের বিবাদ শুরু হয়। পরিস্থিতি এমন দিকে এগোয় যে, সারা রাত বরসহ বরযাত্রীকে মেয়ের বাড়িতে আটকে রাখা হয়। সকালে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সারা রাত আটক থাকার পর মুক্ত হয়ে পাত্র কারি ইমরান কয়েক ঘণ্টা আগে বিবাহিত স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার দাবি, অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

চার. প্যারাগুয়ের বাসিন্দা এক ব্যক্তি সম্প্রতি স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছেন। ওই ব্যক্তি গুগল ম্যাপ চেক করছিলেন। তার লিমায় যাওয়ার কথা। কিন্তু গুগল ম্যাপে ট্রাফিক আপডেট দেখতে গিয়েই তার চোখ কপালে ওঠে (গুগল ম্যাপে ট্রাফিক সিগন্যালের ছবি দেখা যায় ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে)। তিনি দেখেন রাস্তায় এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। এর পরই তিনি ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেন (ডেইলি মেইল)।

পাঁচ. সংযুক্ত আরব আমিরাতে নতুন বিয়ে করা এক ব্যক্তি মেকআপ ছাড়া প্রথমবার তার নববধূর মুখ দেখে বিস্মিত হয়েছেন। মেকআপসহ তাকে যেরকম দেখা যায়, মেকআপ ছাড়া দেখলে তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় না। শারজার আল মানজার সৈকতে বেড়াতে যান নবদম্পতি। সেখানে গোসলের পর মেকআপ উঠে গিয়ে নববধূর প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে পড়ে। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তার স্বামী। প্রতারণার অভিযোগে তিনি তার স্ত্রীকে তালাক দেন।

এ যুগের মানুষ খেলনা। মানবজীবন খেলনা। মানবাধিকার খেলনা। আমাদের মানবাধিকার বিষয়ে আজ সবাই কথা বলছেন। যারা আমাদের সকাল-বিকাল নসিহত করছেন, তারাই আবার ভয়ঙ্কর সব মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন। দুর্বল মানবের অধিকার কোথাও নেই। চারদিকে এখন দানবের অধিকার। বিশ্বমানবতা খেলনা। দুর্বল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব খেলনা। জাতীয় পতাকা খেলনা। জাতিসংঘের খেলা (লাগ ভেলকি লাগ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশে...) দেখে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়। খেলছে তারা এ পৃথিবী লয়ে। একেক সময় একেক পদ্ধতিতে। খেলনা যুগে স্বাধীনতা মানে যেন উদরপূর্তি। দুর্বল রাষ্ট্রের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে, খিদে পেলেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাও।

আমরা সবাই খেলনা আমাদের এই খেলনা যুগে। ‘স্থায়ী ও অচ্ছেদ্য বন্ধন’ ইত্যাদি ভারী ভারী ধারণার শিকল থেকে মানুষ আজ মুক্ত। খেলনা যুগের সবচেয়ে ঠুনকো খেলনা হচ্ছে মানুষ, দেশ, বিশ্বাস, হদয় ও প্রেম। মানচিত্র থেকে দেশও হারিয়ে যেতে পারে এ যুগে। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীবন মানুষ আজ খেলনা। মনুষ্যত্ব খেলনা। মানুষের আবেগ অনুভূতি সবকিছু খেলনার মতো আচরণ করছে। সবাই খেলছে এ খেলনা যুগে। আমি তুমি সে। আমরা সবাই। এখন যেটা চলছে সেটা খেলনা যুগ ছাড়া আর কিছুই না। খেলনা জীবনে অবিরাম খেলতে খেলতে আমরা সবাই ভীষণ ক্লান্ত। এক খেলনা আরেক খেলনা দিয়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ে তাদের খেলনা জীবনে। এভাবেই চলছে আমাদের তথাকথিত খেলনা জীবন। আমিও খেলনা যুগের এক অতি সাধারণ প্রতিনিধি। এ লেখাটিও খেলনা যুগের একটি খেলনা লেখা মাত্র।

 

তথ্যসূত্র : মরহুম কবি আবিদ আজাদের

খেলনা যুগ কবিতা অবলম্বনে

লেখক : সাংবাদিক ও রম্যলেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads