• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

স্বাধীনতার অঙ্গীকার রক্ষা পাক

  • জি. কে. সাদিক
  • প্রকাশিত ২২ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশি বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দীর্ঘ ন’মাসের আত্মত্যাগের সফলতার মাস ডিসেম্বর। আমাদের দেশের আপামর জনতার রক্তের বিনিময়ে ঔপনিবেশিক শক্তিমুক্ত একটি মানচিত্র পেয়েছি। এই যে স্বাধীনতা, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিকামী মানুষের রক্ত-সম্পদ-সম্ভ্রমহানির আর্তনাদের ঐতিহাসিক পবিত্র অঙ্গীকার। যার লক্ষ্য ছিল— সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। এই অঙ্গীকারনামা রক্ষার দায়িত্ব এদেশের আপামর জনতার, যা আমরা আমানত হিসেবে সাকুল্যের পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও স্বাধীনতার অঙ্গীকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাজনৈতিক দলের হাতে অর্পণ করি। কিন্তু আমাদের জাতীয় দুঃখ হলো আমরা প্রতারিতের দল। গত ৪৮ বছর প্রতারিত হয়েছি। এবারের বিজয় দিবসে আমরা ‘খাঁটি তাওবা’ চাই। নইলে যারা আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার, বীর সন্তানদের রক্ত ও সম্ভ্রমের সঙ্গে বেঈমানি করেছে, তাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে হবে। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জনতার হাতে সে শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে। যার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার রক্ষা পাবে বলে আশাবাদী।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সারা দেশে ভোটের প্রচারণা চলছে; আর সমতালে চলছে সহিংসতা। একের প্রতি অপরের বিদ্বেষে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বৈষম্য ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দমন ইত্যাকার বিষয় থেকে বাঙালির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দীর্ঘ সময়ের জমাট বাঁধা ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয় ১৯৭১ সালে। দীর্ঘ তেইশ বছর পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত একটা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবি থেকেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম। যে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথচলার জন্য বেছে নেয়া হয় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে। জাতীয়তাবাদ কথাটা পরে যুক্ত করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে যে সহিংসতা চলছে তা আমাদের স্বাধীনতার মূল চেতনাকেই লাঞ্ছিত করে। আমরা তথা এদেশের মালিক সাধারণ জনগণ এটা চাই না। বাংলাদেশকে ঘোষণা করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। যেখানে জনগণ সমস্ত ক্ষমতার মালিক। জনগণ নির্বাচনী উৎসব করার মধ্য দিয়ে তাদের সমস্ত ক্ষমতার প্রতিফলন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ও নির্বিঘ্নে দেখাতে চায়। এখানে সে দলই স্বাধীনতার মূল চেতনা লালন করে যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে শ্রদ্ধা দেখায়, সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা ও সকল ধর্মের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। পাকিস্তানিদের সহিংস রাজনীতির ফলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। দুঃখের বিষয়, আজ স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক সময় পরও আমাদের দেশে সহিংসতার রাজনীতি চলছে। এটা কাম্য ছিল না। কিন্তু কাম্য না হওয়ার পরও গত ১৩ ডিসেম্বর সারা দেশে নির্বাচনী প্রচারণা ঘিরে ৩০টির মতো সহিংস ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশে এখন স্বাধীনতার নাম ভাঙিয়ে, স্বাধীনতার চেতনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ব্যবসা চলছে। এ কথাগুলো শুনতে খারাপ হলেও বাস্তবতাহেতু উদাহরণ আমাদের সামনে বিদ্যমান।  ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বর— এসব দিন আমাদের সত্তার সঙ্গে জড়িত। তাই বছরে দু-একদিন শুধু উৎসব করে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কথা না বলে সারা বছর স্বাধীনতার অঙ্গীকার রক্ষার প্রাণান্তকর প্রয়াস আজ জরুরি। ’৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হত্যার দিন। সারা দেশে শোকাবহ চিত্তে এ দিনটি পালিত হয়। এদিন পাকিস্তানিরা এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় আমাদের দৃঢ় চেতা, স্থির চিত্তের, অবিচল বিশ্বাসী একদল মানুষকে হত্যা করেছে। যারা জীবনের কোনো কিছুর বিনিময়েই বাঙালি জাতির স্বাধীন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি থেকে টলে যাননি। দৃঢ় চেতা আদর্শের সামনে মৃত্যু একটা স্বাভাবিক পরিণতি। আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ সে দৃঢ়তা দেখিয়েছেন। ‘সুবিধাবাদ’ বলে যে শব্দ সেটা তাদের ছুঁতে পারেনি। যার ফল জীবন দিয়ে শুধিয়েছেন। আমরা আজ সে দেশটায় বাস করছি। মহৎ আদর্শের মানুষগুলোর জীবনী চর্চা করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা তাদের যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারিনি, পারছি না। ১৯৫৩ সালে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী স্বীয় বন্ধুবর ব্যক্তি রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে কারাগারে বসে ‘কবর’ নাটকটি লেখেন এবং সেটি কারাগারেই প্রথম মঞ্চস্থ হয়। মুনীর চৌধুরী যে আন্তর্দৃষ্টি নিয়ে ‘কবর’ নাটক লেখেছিলেন সে শিকার তিনি নিজেই হয়েছেন।

জনতার ন্যায্য দাবিকে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা আরো নানা অজুহাতে শাসক শ্রেণি কীভাবে দমায় সে প্রেক্ষিত বর্ণনায় ‘কবর’ নাটকটি উঁচু স্তরের একটি শিল্পকৃতি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনা উপজীব্য করে নাটকটি লিখিত। নাটকটির আবেদন শুধু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রে জনগণের ন্যায্য অধিকার দমনের এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ পরিণতি কী হতে পারে, মুনীর চৌধুরী সে ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। যার শেষ পরিণতি আমাদের স্বাধীনতা। মজার ব্যাপার হলো, নাটকের আবেদন স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হলো না। বর্তমানে দেশের

রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ‘কবর’ নাটকের আবেদন পুরোদমে মজুদ।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক নগ্নতার বিন্দুমাত্র ছায়াও যদি আমাদের স্বাধীন দেশে বিদ্যমান থাকে, তাহলে আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার এখনো পুরো বাস্তবায়ন হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতো যদি অগণতান্ত্রিক কার্যাবলির দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস, বিরোধী রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শকে দমন, স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সংহতির নামে জনমত দমন করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়, তা হলে আমাদের স্বাধীনতা ‘বেহাত বিপ্লব’। তাই এই বিজয়ের মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদের রক্তের পবিত্র আমানত রক্ষার জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার অঙ্গীকার রক্ষায় দৃঢ় থাকবে এটাই কামনা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads