• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
ঘটনাপ্রবাহের নায়ক আমজাদ হোসেন

প্রয়াত আমজাদ হোসেন

সংগৃহীত ছবি

মতামত

ঘটনাপ্রবাহের নায়ক আমজাদ হোসেন

  • আহমেদ তেপান্তর
  • প্রকাশিত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

আমজাদ হোসেন ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি। পথচলা গল্প আর কবিতা দিয়ে। লিখেছেন বহু কালজয়ী উপন্যাস আর গল্প। প্রথম জীবনে লেখালেখিতেই আমজাদ হোসেন হয়ে উঠেছেন। কালক্রমে সেলুলয়েডে আসক্ত হলে দ্রুতই রপ্ত করেন সেটার ভাষা। হয়ে ওঠেন সেলুলয়েডের সহযাত্রী, পরবর্তীকালে এক কিংবদন্তি। বাংলা চলচ্চিত্রে বহুমাত্রিক প্রতিভা খান আতা এবং জহির রায়হানের রসায়নের এক চরিত্র আমজাদ হোসেন। এই ত্রয়ীর কাছে বাংলা চলচ্চিত্র অসম্ভব ঋণী। কিংবদন্তির প্রস্থানে উঠে আসছে তার কর্মময় জীবনের স্মৃতিকথা। অন্য সবার মতো আমিও স্মৃতিকাতর। দুইভাবেই জানি। সাহিত্যিক হিসেবে কখনো, আবার নির্মাতা হিসেবে তার অনবদ্য সৃষ্টি দেখে। তবে যে ঘটনা আজ বলব সেটা দুইয়ের সমন্বয় ঘটনাপ্রবাহের নায়কের ভূমিকায় থাকা আমজাদ হোসেনকে।

ঘটনাপ্রবাহ ২০১৭ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়। নিউইয়র্কে খ্যাতিমান সব্যসাচী নির্মাতা, সংগীতজ্ঞ, ভাষাসৈনিক, অভিনেতা, সাংবাদিক খান আতাউর রহমানের মতো ব্যক্তিকে যখন ‘রাজাকার’ বলে সম্বোধন করা হয় এ ব্যাপারে তার অবস্থান ছিল খুবই ইতিহাসনির্ভর এবং বস্তুনিষ্ঠ। ওই ঘটনায় খুব কাছ থেকে খান আতাউর রহমানের স্নেহের আমজাদ হোসেনকে অশ্রু বিসর্জন দিতে দেখেছি। এই সঙ্গে প্রতিবাদে মুখর হতে দেখেছি পুরো চলচ্চিত্রপাড়া, নাট্যাঙ্গন, দেশের আপামর জনতাকেও। তারা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মতো বরেণ্য মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকের এমন কর্মে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। ওই সময় বরেণ্য অভিনেতা ফারুক আর আমজাদ হোসেনকে দেখেছি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে। তাদের সে যাত্রায় মনে পড়ে খান আতার একসময়ের অনেক সহকর্মীও যুক্ত হন।

প্রত্যেকের মধ্যে এক আশ্চর্যরকম অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিলেন এই আমজাদ হোসেন। ওই ঘটনাপ্রবাহের কিছু কিছু জায়গায় ছিলাম বলে সামনে থেকেই প্রত্যক্ষ করেছি তার আবেগ এবং খান আতার প্রতি ভালোবাসা। একই সঙ্গে ভুলে যাননি বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চায়ও। এ জায়গায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন আবেগবিবর্জিত এক ইতিহাসবিদ। ঘটনাপ্রবাহে আমাকে খান আতার অজানা অধ্যায় নিয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামসুল আলম বাবু।

সে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ঘটনাপ্রবাহের শুরুতে লিখেছিলাম  “খান আতাকে ‘রাজাকার’ বলে তোপের মুখে ‘দালাল’ বাচ্চু।” লেখাটি ১৪ অক্টোবর দৈনিক আজকালের খবরে প্রকাশিত হয়। ওই লেখার একটি অংশে প্রমোদকার গোষ্ঠীর পরিচালক সিবি জামানের বরাত দিয়ে লিখেছিলাম, “অনেক আগে এ নিয়ে বিতর্ক উঠলে সে সময় একটি দৈনিকে লিখেছিলাম ‘খান আতাকে যারা রাজাকার বলেন তাদের মুখে জুতা মারা উচিত’।” আমজাদ হোসেন আমাকে ডেকে পাঠালেন। গেলাম পরিচালক সমিতিতে। এক পাশে ডেকে বললেন- তোমার লেখা সবটাই ভালো লেগেছে, বুঝতে পারছি আতা ভাইকে ভালোবাস; কিন্তু এটা ভুলে যাওয়া চলবে না তুমি একজন সাংবাদিক। যে শব্দটা লিখেছ সেটা অত্যন্ত আপত্তিজনক। সে বলছে মানে এই নয়, তুমি সেন্সর করবে না। এটা ঠিক হয়নি। বললাম-জি ভাই।

পরেরদিন প্রকাশ পেল “খান আতা ‘রাজাকার’, বাচ্চুর কাছে জবাব চাইলেন ফারুক।” লেখাটি পড়ে ডেকেছিলেন। ভয়ে ভয়ে গেলাম। কারণ তিনি কেবল নির্মাতা বা চিত্রনাট্যকার ছিলেন না, উঁচুমাপের লেখকও। ভাবছিলাম আগের দিনের ভর্ৎসনা আজো বুঝি জোটে কপালে। কিছুটা ভীত। বিকাল নাগাদ গেলাম। সমিতির বাইরে পরিচালক কাজী কামাল ভাইয়ের পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। আমার লেখাটি হাতে সি বি জামান। তার সঙ্গে রেজা হাসমত, শিল্পী চক্রবর্তীসহ আরো তিন-চারজন। ক্ষণিকবাদে আমজাদ হোসেন (ভাই) এলেন, ফাঁকা চেয়ারে বসলেন। ঘামছিলাম। কামাল ভাই চায়ের অর্ডার করলেন আমার জন্য। পাশ থেকে আমজাদ ভাই বললেন, ‘ও আমার গেস্ট, আমি চা খাওয়াবো’ বলেই তিনিও চায়ের জন্য হাঁক দিলেন। বললেন— ফারুকের বক্তব্যটা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছ। বেশ তথ্য-উপাত্ত রয়েছে দেখলাম, বলেই পিঠ চাপড়ে দিলেন। ঘামটা ততক্ষণে স্বস্তিদায়ক মনে হতে লাগল।

ধারাবাহিকভাবে খুব সম্ভবত ১৭ অক্টোবর বিশিষ্টজনদের বক্তব্য নিয়ে আমার একটি লেখা প্রকাশ করেছিল দৈনিক আমাদের সময়। সেখানে অপরাপর খ্যাতিমান নির্মাতা-অভিনেতাদের সঙ্গে আমজাদ ভাইয়ের প্রতিক্রিয়াও ছাপা হয়েছিল। সেখানে একটি শব্দ নিয়ে তিনি আপত্তি তুলেছিলেন। শিল্পী সমিতির আঙিনায় এ নিয়ে আলাদা ডেকে কথার ফাঁকে বলেছিলেন, ‘ভুলে যেও না বাচ্চুও একজন মুক্তিযোদ্ধা, তিনিও ফেলনা নন।’ অথচ অনেকেই আমাকে সেই বাক্যের জন্য বাহ্্বা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমজাদ হোসেনের কাছ থেকে যখন বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা পেলাম তখন মনে হলো সত্য বচনটা উনি-ই বললেন। একজন লেখক বা সাংবাদিক হিসেবে এটা আমার জন্য সৌভাগ্যের কারণ নইলে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ওই রাতে সুনসান নীরব এফডিসিতে খান আতাকে নিয়ে কী করলে তার সম্মান অক্ষুণ্ন থাকবে, সে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। চলে ১২টা অব্দি। আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে আমার উপস্থিতিও বরাবরের মতো ছিল। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো এফডিসিতে খান আতার ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি প্রজেকশন করা হবে, সঙ্গে আলোচনা। এজন্য পত্র-পত্রিকার কাটিংগুলো সংগ্রহ এবং আলোচনার লাইনআপ তৈরি করা হয়। পাশাপাশি  একাত্তরে পুরো ঘটনার অন্যতম সাক্ষী আবু মুসা দেবু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তিগুলো মনে করিয়ে দিলেন। সব যখন স্থির, বিপত্তি দেখা দিল আয়োজনের অর্থ সংগ্রহ নিয়ে। শেষপর্যন্ত  আমজাদ হোসেন বললেন, ফারুক তুমি আর আমিই আয়োজনটা চালিয়ে নিই। আতা ভাই অনেক করেছেন, তার জন্য যদি সামান্য কিছু করতে পারি সেটা আমাকে তৃপ্ত করবে। 
এভাবেই ১৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন হয়। সেদিন দুঃখের স্রোতে কাতর আমজাদ হোসেন অশ্রুসজল নয়নে বলেছিলেন, “কিছু দুঃখের কথা বলতে চাই। সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় দুঃখের সময় নয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলটল করে ওঠে, দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ, ফুটপাত দখল হয় মধ্যরাতে। আমার বড় ভাই, আমার বাবাকে একজন গালি দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আমরা একটা গালি তৈরি করেছিলাম। সে গালিটির নাম ‘রাজাকার’। যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন তাদের আমরা এই গালিটি দিতাম। আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশের প্রথম নায়ক খান আতাউর রহমান। যিনি এজে কার্দারের ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। বাচ্চু সাহেব তুমি আমার দেশের লোক। তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তুমি কেন এই গালিটা আতা ভাইকে দিলে? সে তো তোমার কোনো ক্ষতি করে নাই। তিনি দশ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তুমি কেন তার সম্পর্কে এই গালিটা উচ্চারণ করলে? তুমি যদি সত্যিই এ কথাটা বলে থাক, তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে চলচ্চিত্রের মানুষের কাছে, বাংলার মানুষের কাছে। খান আতা আমার হূদয়ের ৩২টি হাড়ের মতো। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি দেখানোর জন্যই এ আয়োজন। সবাই দেখে বুঝুক কী ছবি খান আতা তৈরি করেছিলেন। একজন মৃত মানুষকে কবর থেকে তুলে তাকে অপমান করার অধিকার তোমার নেই। এর বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম।”

এমন খেদোক্তির পর আমজাদ হোসেন নিজের আবেগ যেভাবে ধরে রেখেছিলেন তা ছিল অবাক করার মতো। অথচ অনুষ্ঠানে সবথেকে আবেগতাড়িত সমালোচনা তিনিই করেছিলেন, সেখানে সাহিত্যপাঠও ছিল, ছিল পারস্পরিক সম্মানবোধ, চেতনাতেও উপস্থিত সবাইকে শানিত করেছেন মায়াময় শব্দের পিক্তমালায়। সম্মানবোধ কেবল খান আতার প্রতি দেখিয়েছিলেন তা নয়, একই সঙ্গে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর প্রতিও। 

মানুষ মরণশীল। আমজাদ হোসেন সে পথের নিয়মিত যাত্রীর একজন। অসুস্থাবস্থায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রমাণ করে তার অনন্য উচ্চতার কথা। সেলুলয়েডের সন্তান হয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকুন আমজাদ হোসেন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads