• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান ও ‘বীরাঙ্গনা’

নারীযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গুটিকয় নারী

সংগৃহীত ছবি

মতামত

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান ও ‘বীরাঙ্গনা’

  • আলতাফ হোসেন
  • প্রকাশিত ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ জীবন অধ্যয়নের একটি বড় দিক। এই যুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নিম্নবর্গের নারীরাই ব্যাপকভাবে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। নারীর ইতিহাস সুশীল সমাজের কাছে উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পর।

মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে কিছু গবেষণা হলেও সাধারণ শিক্ষিতজন এবং নিরক্ষর মানুষের মধ্যে তেমন পরিচিতি লাভ করেনি। নারীযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গুটিকয় নারী। যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে নারীদের ধর্ষণের ঘটনা প্রচার লাভ করেছে অনেক বেশি। যে কারণে নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষিতজনরা অবলীলায় বলে যান, ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। ধর্ষণ, নারী নিপীড়নের ঘটনা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা। যুদ্ধের সময়ে নারী-ধর্ষণ শত্রুপক্ষের যুদ্ধ কৌশল। এর দ্বারা লড়াকু প্রতিপক্ষকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এখানে ইজ্জতের প্রশ্ন ওঠে না।

সাধারণ মানুষ জানতে পারবেন যুদ্ধ নারীকে কত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাননি। অদৃশ্য হয়ে গেছে এসব নারী। এগিয়ে আছে পুরুষরা। কারণ ক্ষমতা, রাজনীতি এবং পুরুষতন্ত্রের সুবাদে পুরুষরা সুযোগ গ্রহণের মুখ্য ভূমিকায় থাকে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা এবং সাহসের ফল এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। যেমন- কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা। তাদের মতো অনেক নারী সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের খতম করেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। কলকাতার পার্ক সার্কাস ও পদ্মপুকুরের মাঝামাঝি গোবরা নামের স্থানে শুধু মহিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। অনুরূপ আরো তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে।

ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। কবি, লেখক, সাংবাদিক এবং শিল্পী- এরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। এরা ছিলেন যুদ্ধের প্রেরণা। আবার দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এদেশের গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, বন্দরে অসংখ্য নারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন।

তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। জুগিয়েছেন খাদ্য, অস্ত্র বহন করেছেন, লুকিয়ে রেখেছেন, গোপন সংবাদ আনা-নেওয়া করেছেন। যেমন— কবি সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, বেবী মওদুদ। এ ছাড়া হাজার হাজার নাম-না-জানা নারী আছেন যারা নিজের সব স্বার্থ ত্যাগ করে, সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে দেশমাতার জন্য নিজের সন্তান, কখনো-বা স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের আশি শতাংশ নারী হয়তো এই শ্রেণিতে পড়েন। অথচ এই নারীরা তাদের অবদানের স্বীকৃতির পরিপূর্ণতা পাননি আজো।

পাকিস্তাানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এদেশের প্রায় তিন লাখ নারী। তারা ধর্ষিত হয়েছেন, নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা সহ্য করেও প্রাণে বেঁচে গেছেন। এরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও নৈতিকভাবে পরাজিত হননি। এরা আপস করেননি পাকিস্তানিদের সঙ্গে। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এরা স্বামী, পুত্র, ভাইকে ধরিয়ে দেননি শত্রুর হাতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads