• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

টি এন সেশন, নির্বাচনী সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের নির্বাচন

  • তাহসিন আহমেদ
  • প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

টিএন সেশন দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচনী সংস্কৃতিতে আলোচিত একজন ব্যক্তি। ভারতের দশম প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে (মেয়াদকাল ১৯৯০-১৯৯৬) দায়িত্ব পালন করেছেন। আপস করেননি সরকার ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে। টি এন সেশনের ব্যক্তিত্ব, সততা ও আদর্শের কারণে ভারতের নির্বাচনী সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে। দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোতে নির্বাচন এলেই বার বার আলোচিত হয় টি এন সেশনের নাম।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদী শাসন যেসব দেশে বিদ্যমান, সেই দেশগুলোর ক্ষমতাসীন দলসমূহের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রায় প্রত্যেকেই প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে নির্বাচনে প্রভাবিত করতে পছন্দ করে। এই চেনা ছকটিকে বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশন যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল যেন প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে জন্য তিনি জোর গলায় বলতে পেরেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী নয়, আমার কথাই চূড়ান্ত। সেশন রাজনীতিবিদ ও আমলাদের রাহুগ্রাস থেকে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পরিচ্ছন্ন করতে পেরেছিলেন সাহসী ভূমিকায়। রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে বার বার আদালতে গেছেন তিনি। নির্বাচন বন্ধ রেখে হলেও দাবি আদায় করে ছেড়েছেন। তার প্রধান সফলতা ছিল নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ এখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করা। যে রাজ্যেই যখন নির্বাচন হতো, সেখানে পুলিশ ও প্রশাসন হাতে নিয়ে নিতেন সেশন। বিশাল ভারতে নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ছবিযুক্ত পরিচয়পত্রের প্রচলন তার অসাধারণ একটি কৃতিত্ব।

২.

বাংলাদেশে আর মাত্র তিন দিন পর সংসদ নির্বাচন। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর আমরা যখন আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে গর্ব করতে পারতাম, ঠিক তার ৬ বছর পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ছাড়া ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনটির ৩ মাস পর আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নতুন ফর্মুলায়। এক নতুন জামানায় প্রবেশ করে বাংলাদেশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে পরিচিত নির্বাচনকালীন সরকারটির বৈশিষ্ট্য ছিল একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে বাকি ১০ জন নির্দলীয় ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি ৯০ দিনের সরকার থাকবে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনের সমন্বয়ে কাজ করবে।

৩.

১৯৭০ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের একমাত্র অবাধ, সুষ্ঠু ও সর্বজনীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কৃতিত্ব বিচারপতি আবদুস সাত্তারের। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি মুহাম্মদ ইদ্রিস। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, প্রার্থী অপহরণের মহড়া, কেন্দ্র দখল ও অরাজকতা ওই নির্বাচনকে

কলঙ্কিত করে। ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনের ১৫ বছরের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যথাক্রমে দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি নূরুল ইসলাম ও বিচারপতি এ টি এম মাসুদ।

এরশাদের জামানায় বিচারপতি নূরুল ইসলামের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আপত্তি জানালে বিচারপতি এ টি এম মাসুদকে নতুন সিইসি পদে বসানো হয়। সেই মাসুদ ১৯৮৬ সালের ‘মিডিয়া ক্যু’র নির্বাচনটি সম্পন্ন করেন। আর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিচারপতি নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন। এরপর যথাক্রমে সিইসির দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, বিচারপতি আবদুর রউফ, বিচারপতি সাদেক, মোহাম্মদ আবু হেনা, এম এ সাঈদ, বিচারপতি এম এ আজিজ, এ টি এম শামসুল হুদা।

৪.

বিএনপির শাসনামলে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের সময় যেমন বিতর্কিত হয়েছেন বিচারপতি সাদেক, একই ভূমিকায় আওয়ামী শাসনামলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের কারণে বিতর্কিত হয়েছেন রকিব উদ্দিন আহমেদ। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে সাবেক আমলা আবু হেনা, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিচারপতি এম এ সাঈদ সাহসী ভূমিকায় ছিলেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এ টি এম শামসুল হুদা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (মেয়াদকাল ১১ জানুয়ারি ২০০৭ — ৩০ ডিসেম্বর ২০০৮) সিইসি হিসেবে কাজ করেন। শুরুতেই তিনি প্রধান দুই দল ভেঙে সংস্কারপন্থিদের নির্বাচনে আনার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির স্থগিত হওয়া নির্বাচনে বিএনপি নিয়ন্ত্রিত বিচারপতি এম এ আজিজ ২০০৬ সালের অক্টোবরের ২৮ তারিখ বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিতর্কিত হন। নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত না হওয়ায় তাঁর ঘাড়ে কোনো বিতর্কিত নির্বাচনের দায় নিতে হয়নি। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে সেই বছরের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনটি স্থগিত হয়ে যায়।

৫.

আজ থেকে মাত্র ৩ দিন পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের বিরোধী পক্ষে রাজনীতিবিদদের প্রচারণায় ক্রমাগত হামলা, মামলা ও পোস্টার ছাপানো, মাইকিংয়ে বাধা দিয়ে নজিরবিহীন আতঙ্কের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও মারা গেছে দলীয় লোকজন। এই যখন অবস্থা তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? কে আসলে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যর্থ সিইসি- এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য প্রতিটি নির্বাচনের চিত্র বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে দিন যত গড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবলে সে নিজেই বোকার স্বর্গে বাস করবে।

৬. 

৩০ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের বিজয়, পাতানো নির্বাচন নাকি নির্বাচনটি স্থগিত হবে- এই তিনটি প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। শেষবিচারে জনগণ ভোট দিতে গেলে গণতন্ত্রের বিজয় হবে। আর আবারো পুরনো ছকে যদি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তবে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ একটি ব্র্যাকেটবন্দি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আমাদের সবার প্রত্যাশা থাকবে বাংলাদেশ পেছনে না গিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে- গণতন্ত্রের পথে। জয় হোক বাংলাদেশ ও তার মানুষের।  

 

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads