• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

সমাগত নতুন বর্ষ

কী নিয়ে জাতি পদার্পণ করবে

  • ফাইজুস সালেহীন
  • প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

আর মাত্র পাঁচ দিন, তারপরেই মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যাবে আরো একটি বছর। আমরা পদার্পণ করব ২০১৯ সালের প্রথম প্রহরে। স্বাধীন-সার্বভৌম শস্য-শ্যামল এই ব-দ্বীপে নতুন বছরটি  কেমন হবে, কেমন যাবে— সেই বার্তাটি পাওয়া যাবে তিরিশ তারিখে। আমাদের জাতীয় জীবনে আঠারো সালের বিদায়ের এই বেলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একাদশ সাধারণ নির্বাচন একদম কাছে চলে এসেছে। মাঝখানে মাত্র তিনটি রাত। কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিবেশ পরিস্থিতি যেমন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক নয়। ইলেকশনের ছয় দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিঘ্ন সৃষ্টির তৎপরতা থামেনি। বিএনপি ও বিরোধী দল শুরু থেকেই নির্বাচনের মাঠে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারসহ সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের দাবি করে আসছিল। দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি দেশের মানুষের অনেক ভরসা। সেনাসদস্যদের পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে কোনো সন্দেহ নেই। সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর আশা করা গিয়েছিল যে নির্বাচনী পরিবেশে দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন আসবে। আইন মেনে সব পক্ষ ক্যাম্পেইন করতে পারবে। প্রচার-প্রচারে বাধা দেওয়া, মিছিলে হামলা এবং ভাঙচুরের মতো অপকাণ্ড হয়তো আর ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে; মিডিয়ায় প্রতিদিনই হামলা, মামলা, গ্রেফতার ও আটকের খবর আসছে। নির্বাচন সামনে রেখে জনমনে যে শঙ্কার কালো মেঘ দানা বেঁধে উঠেছিল, তা এখনো কেটে যায়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবাধ ও নিরপেক্ষ ইলেকশনের জন্যে ভয়শূন্য পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।

ভয় আর গণতন্ত্র  একসাথে থাকতে পারে না। কেন পারে  না, তা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বলার দরকার হয় না। যে ভয়ের মধ্যে আছে, সে খুব ভালো করেই জানে যে, তার মতামতের কোনো দাম নেই। তার পছন্দ-অপছন্দে কারো কিছু যায় আসে না। বরং হিতেবিপরীত হতে পারে। কাজেই যা হয় হোক গে! এই বেলায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। এ অবস্থায় কিছুতেই সে তার মতটা প্রকাশ করতে চাইবে না। মানুষ নিজের মত গোপন রেখে যদি ঘরে বসে থাকেন, তাহলে আর যাহোক, ভোটে জনমতের যথার্থ প্রতিফলন ঘটবে না। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথাটিই হলো দেশ চলবে জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী। তারাই স্থির করবেন, কারা দেশ চালাবেন। ভোটের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে জনগণের পছন্দের বিষয়টি। এ হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। একে আমরা গণতন্ত্রের স্টার্টারও বলতে পারি। গণতন্ত্রের চাকা ঘুরতে শুরু করে তারপর। কিন্তু এই জায়গাটায় সমস্যা দেখা দিলে গণতন্ত্র ঠিকমতো কাজ করবে না, করতে পারে না। গতকাল বুধবার পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্ত থেকে যেরকম খবর পাওয়া গেছে, তাতে সাধারণের বিচলিতবোধ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

ইলেকশনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও প্রার্থীর জন্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কি নেই, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা বলছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকলেও বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট চক্রান্ত করছে নির্বাচন বানচাল অথবা একে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যে। দেশের অনেক জায়গায় প্রতিপক্ষের প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারছে না। প্রচারে বেরুলেই হামলা। গাড়ি ভাঙচুর। কিন্তু কোথায় কারা হামলা করছে, তা স্পষ্ট করে জানা যাচ্ছে না গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত খবরে। ফলে পারস্পরিক দোষারোপ চলছে সমান তালে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনের দুতিন দিন আগে হাঙ্গামা করার পরিকল্পনা করছে। তিনি এমনও বলেছেন, বিএনপি নকল ব্যালটপেপার ছেপে জাল ভোট দিয়ে নির্বাচনে জেতার আয়োজন করছে।

বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের নালিশেরও কোনো অন্ত নেই। অন্যদিকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরও আটক ও গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। বস্তুত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীর পক্ষে আটক ও গ্রেফতার বন্ধ করা কঠিন। এ বিষয়টি  নির্ভর করে পুলিশের ওপর। দেশে আইনের অভাব নেই। আইন দেখিয়ে আটক বা গ্রেফতার পুলিশ করতেই পারে। মামলা দেওয়াও বন্ধ করা যাবে না। এই জায়গায় সেনাবাহিনীর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। বিএনপির প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এর আগে বলেছেন যে, যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে, তাদেরই কেবল গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার ও আটকের এই প্রক্রিয়া চালু থাকলে সেটাকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলা যায় কি-না, সে এক ভাবনার বিষয়। বাড়ি থেকে বেরুবার পথে গ্রেফতার বা আটক হয়ে যাওয়ার ভয়ে যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোটার বাড়িতেই বসে থাকেন, তাহলে সেনাসদস্যরা কী করে তাদের ভয় ভাঙাবেন! এই বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশনকেই ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সিইসির সঙ্গে বৈঠক বর্জন করেছেন। পরে তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেন। রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি জানান অবিলম্বে নতুন ইলেকশন কমিশন গঠনের। শেষবেলায় এসে এরকম দাবি ঘোলাটে পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইলেকশন কমিশন বিদ্যমান সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতেও  নির্বিকার। সিইসি নির্বাচন প্রসঙ্গে অনেক কথা বললেও ভোটারের নিরাপত্তা এবং প্রত্যেকেই যাতে নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে বিষয়ে টু শব্দটি করেননি।

আমরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাই, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। কিন্তু এসব চাওয়া অর্থহীন, যদি ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে না যান অথবা ভোট দিতে না  পারেন। সব দল অংশগ্রহণ করলে এক অর্থে ইলেকশন অংশগ্রহণমূলক হয়ে যায়। কিন্তু একটা নির্বাচনে একাধিক প্রার্থীর অংশগ্রহণ যেমন জরুরি, তেমনি অত্যাবশ্যকীয় ভোটার সাধারণের অংশগ্রহণ। এক বিরাট সংখ্যক ভোটার যদি ভোট দিতে না পারেন অথবা ভোট প্রদানে বিরত থাকেন, তাহলে সেটাকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে না। কাজেই ইলেকশনটা হওয়া উচিত সকল অর্থে অংশগ্রহণমূলক, পারশিয়ালি পারটিসিপেটরি নয়।

আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে, ফ্রি ফেয়ার ইলেকশনের পথ অবরুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ ও বিজয় কোনোটাই সম্ভব নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে বড় দলিল। শাসনতন্ত্রে যে চারটি মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে, গণতন্ত্র তার অন্যতম। সংবিধানের মুখবন্ধেও বলা হয়েছে গণতন্ত্রই ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রেরণা। বাংলাদেশ পরিচালিত হবে গণতান্ত্রিক নীতি-ব্যবস্থায়। কিন্তু নির্বাচনটাই যদি ঠিকমতো না হয়, তাহলে গণতন্ত্রের সেই অঙ্গীকার পূরণ হবে কেমন করে? গণতন্ত্রের দাবি লঙ্ঘিত হলে প্রকারান্তরে শরবিদ্ধ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। নব্বইয়ে গণতান্ত্রিক বিজয়ের পর এই দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একটি দলীয় সরকারের অধীনে।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপেক্ষা করে বেগম জিয়ার সরকার একটা প্রহসনের নির্বাচন করেছিল। ভোটারবিহীন সেই ইলেকশনের মধ্য দিয়ে তথাকথিত নির্বাচিত পার্লামেন্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাস করে এবং তার পরপরই বেগম জিয়া ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সেই যুক্তিতে আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দলীয় সরকার বহাল রেখে নির্বাচন হয়ে থাকে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচনে কোনো বিঘ্ন ঘটে না। কেননা নির্বাচন কন্ডাক্ট করে ইলেকশন কমিশন। প্রশাসন কমিশনের অধীনে চলে আসে। বহাল দলীয় সরকার কেবল রুটিন কাজ চালিয়ে যায়। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দলীয় সরকার হস্তক্ষেপ করে না, করার সুযোগও নেই। সে হিসাবে দলীয় সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। আওয়ামী লীগ যে যুক্তিতে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা রহিত করেছে, তার নৈতিক ভিত্তিটি মোটেও দুর্বল নয়। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এবং সময়ের পরীক্ষায় সেটাও ব্যর্থ হয়ে গেলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।

দলীয় সরকারের অধীনে বৈরী পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু স্বাভাবিক হয়নি। এখন দশ বছর পর দলীয় সরকার বহাল রেখে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন ফ্রি ফেয়ার হলে প্রমাণিত হয়ে যাবে যে, দলীয় সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে কোনো বাধা নয়। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের জন্যে তা হবে বিরাট এক নৈতিক বিজয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তখন অর্থহীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে যাবে শক্ত ভিতের ওপর। কিন্তু ঘটে যদি তার বিপরীত, তাহলে দলীয় সরকার বহাল রেখে এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়, সেটাই প্রমাণিত হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের জন্যে তা হবে বড় এক নৈতিক পরাজয়। সংকীর্ণ হবে গণতন্ত্রের পথটিও। বর্তমান সিইসি এবং কমিশনের অন্য সদস্যরা মেয়াদ শেষে চলে যাবেন। তারা আজকে ভুল-ভাল যা-ই করুন না কেন, মানুষ তাদের কথা খুব বেশিদিন মনে রাখবে না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র থাকবে, এদেশের রাজনীতি থাকবে। যে জাতি তিরিশ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছে, গণতন্ত্রের জন্যে যারা সংগ্রাম করেছে দশকের পর দশক, সেই জাতি স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও একটি স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি, তারা গণতন্ত্রের গাছটিকে ফুলে-ফলে বিকশিত হতে দেয়নি; এর চাইতে গ্লানিকর আর কী হতে পারে! জাতীয় জীবনে ব্যর্থতার এই দায় কিন্তু বহন করতে হবে রাজনৈতিক সমাজকেই। রাজনীতির অভিধানে সততা ও শঠতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দেওয়া হলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads