• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

তরুণ ভোটার ও আগামী নির্বাচন

  • মো. মাঈন উদ্দিন
  • প্রকাশিত ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

তারুণ্যই শক্তি, তারুণ্যই আগামী অর্থাৎ যুগে যুগে তরুণদের জয় হয়েছে, জয় হয়েছে তারুণ্যের— এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে বলা যায়, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা দিয়েছে দেশের সোয়া দুই কোটি তরুণ ভোটার। এদের মধ্যে এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন প্রায় সোয়া এক কোটি তরুণ। নির্বাচনী বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তাদের ভোটই পাল্টে দিতে পারে জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ। এ কারণে দেশের বড় দুটি জোটই এই নতুন তরুণ ভোটারদের দিকে নজর রাখছেন। তরুণ ভোটারদের কথা চিন্তা করেই এবারের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনী বিশ্লেষকরা মনে করেন, সম্প্রতি দেশে সংঘটিত বেশ কয়েকটি অরাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে তরুণদের অংশগ্রহণ বিস্মিত করে অনেককে। তাদের সৃজনশীল আন্দোলনগুলো নাড়া দেয় দেশের কোটি মানুষের হূদয়কে। কোটা সংস্কারের আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও তরুণদের সমর্থন ছিল। এর আগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে আন্দোলনে নামে তরুণরাই। আন্দোলনটিও সফল হয়। সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতেও সোচ্চার ছিলেন তরুণ সমাজ। এমনই অনেক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় তরুণরা। লক্ষণীয় বিষয় হলো প্রতিটি আন্দোলনে তারা সফল হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বড় নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে ওই তরুণ প্রজন্ম এমনটাই ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই কোটি। যাদের বয়স ৩০ বছরের নিচে। এ ছাড়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন প্রায় সোয়া কোটি ভোটার। এবারের নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন তারা। গড় হিসাবে দেশে তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ১২ হাজার ১০৫ এবং নারী ৫ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৬ জন। ২০১৮ সালে ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ৪৬ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৫ জন। ভোটারের এ সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন ১ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ২১৪ জন।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মতে, তরুণ ভোটাররা আগামী সংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। কারণ মোট ভোটারের প্রায় চারভাগের একভাগ তরুণ। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত ও আধুনিক বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন। দেশের উন্নয়ন বিবেচনায় তারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। তাই এবার তরুণদের ভোট যে দল এবং প্রার্থী বেশি পাবে, তাদের জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে। ইসির তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের সময় ভোটার ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ জন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে নবম সংসদ নির্বাচনের সময় দেশে মোট ভোটার ছিল ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার। নবম সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত গত ১০ বছরে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২৫ লাখের মতো ভোটার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তালিকায়। এ সময় ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৮ জন, যাদের মধ্যে ১ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ২১৪ জন ভোটার প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন।

ভোটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নবম সংসদ নির্বাচনে জয়ী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছিল মোট ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯ ভোট। আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছিল ২ কোটি ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ১০০ ভোট। সেবার নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করেছিলেন যে, তরুণ ভোটাররা আওয়ামী লীগের এই জয়ে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল, যার ধারা বজায় ছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও।

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চলতি মেয়াদের শেষ ভাগে এসেও তরুণরা নিজেদের দাবি আদায়ে একত্রিত হন। গত অক্টোবরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নামেন প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যাদের অধিকাংশই একাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছেন। সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে।

এরপর চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষভাগে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর দাবিতে মাঠে নামে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও। এসব শিক্ষার্থী ভোটার না হলেও তাদের আন্দোলনে প্রায় সবাই সমর্থন জানান। সরকারবিরোধীদের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনে ইন্ধন ও গুজব ছড়ানো হয়। তবে সেই আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ ও দাবি পূরণে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয় সরকার। এসব তরুণ ভোটারকে গুরুত্ব দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তৈরি করেছে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার।

ভিশন-২০৪১-এর আলোকে নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইশতেহারে জাতিকে টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্নীতি-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল করার প্রত্যয় করেছে দলটি। সেই সঙ্গে রয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার অঙ্গীকার। অর্জন ও ব্যর্থতার পাশাপাশি শুধরে নেওয়ার লক্ষ্যে তুলে ধরেছে ভুলগুলোও। শুধু স্বপ্ন নয়, বাস্তবায়নের নির্বাচনী ইশতেহার করেছে বলে মনে করছে তারা।

দেশ বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে ইশতেহার প্রকাশ করেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জনগণ এ রাষ্ট্রের মালিক— এমন প্রত্যয় নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কথা মাথায় রেখে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কমানোর ঘোষণাসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে থাকছে কৃষকের স্বার্থ, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের কৌশল ও ঘোষণা। কিছু অপ-আইন সংশোধন আর পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য বন্ধের পরিকল্পনাও রয়েছে ইশতেহারে, এমন দাবি তাদের। ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তরুণদের। তরুণদের একাংশের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী সংস্কার করা হবে চাকরিতে প্রবেশের কোটা, কমানো হবে ইন্টারনেটের দাম। এ ছাড়া পরিবহন সেক্টরে দীর্ঘদিনের নৈরাজ্য বন্ধে থাকছে বিশেষ অঙ্গীকার। গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া কার্যকর করা, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো পরিবহন খাতকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে— এমন বক্তব্য ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের।

পরিশেষে বলাই যায়, বর্তমান তরুণরা অনেক সচেতন। তারা নিজেদের কর্মসংস্থান ও সমান অধিকারের বিষয়ে বেশি সচেতন। তাদের বিশ্বাস যে দল অর্জন করতে পারবে, সে দলই তরুণদের কাছে টানতে পারবে।

 

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads