• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার মধ্য দিয়েই আসুক শুদ্ধ গণতন্ত্র

  • সাঈদ চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০২ জানুয়ারি ২০১৯

চারদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। শীতের তীব্রতা শুরু না হলেও হিমেল হাওয়া বয়ে যায় চারদিকেই। খেজুরের রস আসতে শুরু করেছে, পড়েছে পিঠা খাওয়ার ধুম। এ সময়টায় নতুন বিয়ে করা যুগলের আনন্দ আর বেদনার কাব্যের রাসায়নিক বিক্রিয়াটিকে বলা যায় রাতের কাব্য। পাকা ধানের গন্ধ আর শরীরের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সদ্য বিবাহিত মানুষগুলোকে যেন বেঁধে রাখে সারা জীবনের সঞ্চয় অর্জনের বিস্তর ধানক্ষেতের আইলের এক প্রান্তে। পৃথিবীতে দুজন ছাড়া আর কোনো চিন্তা আসে না তখন। গ্রামের পরিশ্রমী তরুণ-তরুণীরাও সারাদিন কাজ করে দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে। ধান মাড়াইয়ের সময় বউ গরুর পেছন পেছন একটি লাঠি নিয়ে শাড়ি আঁটো করে বেঁধে হাঁটতে থাকে আর তরুণ স্বামী তখন ধানের নাড়াগুলো উড়িয়ে দেওয়ায় ব্যস্ত। সবাই একটু আড়াল হলেই দুজনের সামান্য একটু কাছে যাওয়া, শাড়ির আঁচল ধরে টান দেওয়া, চুলে একটু সুড়সুড়ি কাটা, আরো না-জানা রসায়নের কত কী আনন্দ যেন! কৃষক পরিবারে নতুন বিবাহিত তরুণ-তরুণী মানেই হলো নতুন ধানক্ষেত, নতুন শিমের কচি ডগা টিনের চালে উঠে যাওয়া অথবা বিস্তর প্রান্তে সরিষার দোল খাওয়া আনন্দ যেন!

এরকম আনন্দে থেকে থেকেই কেউ কেউ আমরা আজ বেদনার কাব্যে একটি রচনা লিখেছি আর তার নাম ‘বাংলাদেশ’! যে সময়টায় ট্রেনের ঝিকঝাক শব্দে দেহের মাতন উঠত, নতুন বিয়ে করা নতুন শালিক যুগলের ঠিক সে মুহূর্তেই অযাচিত কষ্ট আর মুঠি আলগা করে সব নখ বুকের পাঁজরের মধ্যে বিঁধিয়ে পাঁজর চিড়ে কলিজা টেনে বের করে চোখের সামনে ধরে বলা হলো তোর সব নিয়ে নিলাম, তুই এবার কেঁদে দুঃখ কর!

কোনো উদাহরণ এ কষ্ট বোঝাতে পারবে না। সাংবাদিক, কলামিস্ট সোলায়মান মোহাম্মদের লেখা বাংলাদেশের খবরে প্রকাশিত কলাম পড়ছিলাম সেদিন। শ্রীপুরে সদ্য বিয়ে করা তরুণীর স্ত্রীকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন পাকসেনারা। রেলের ঝিকঝাক শব্দে যখন তারা একে অপরের সুখে বিলীন হওয়ার কথা— ঠিক তখনই সবটুকু সুখের স্খলন ও নিপীড়নের চিহ্ন অংকন!

দুই মাস সংসার জীবন কাটানোর পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে ধর্ষিত ও হত্যার শিকার হন এই নারী। চোখের সামনে থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের আরো কয়েকজন মুরব্বিকে। শ্রীপুরের সাতখামাইরের সেই বধ্যভূমিতে একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয় নয় জনকে।

সদ্য বিয়ে করা সেই বউ, যার গা জুড়ে ছিল ধানের গন্ধ, শিম ফুলের নীলাভ বেগুনি রঙের আভা যার চলার ছন্দ দেখত তার ভালোবাসার স্বামী—তার লাশ পাওয়া যায় নগ্ন অবস্থায় গজারি গাছের সঙ্গে বাঁধা! এ কষ্ট পৃথিবীর কোনো কষ্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সব সুখ কেড়ে নিয়ে এভাবে নির্যাতন চালানো কোনো জাতি পৃথিবীর উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না! যে বর্বর নির্যাতন আমাদের ওপর পাকিস্তানিরা চালিয়েছে তা শুধু বর্বরই ছিল না—ছিল তীব্রতর ঘৃণ্য!

এত কষ্ট ব্যাখ্যা করার মধ্য দিয়ে শুধু একটি পরিবারের গল্পই অসমাপ্তভাবে বলা। এর বাইরে অনেক অনেক পরিবারের কান্না রয়েছে, যেগুলো আমাদের হয়তো সম্পূর্ণই অজানা। ১৫ ডিসেম্বর ছিল গাজীপুর মুক্ত দিবস। এভাবে প্রতিটি অঞ্চলই প্রায় মুক্ত হয়ে এসেছিল এই দিনে। ‘মুক্তি’ কথাটির পেছনের কষ্টগুলো হিসাব করলে আমি তখন স্থবির, বধির আর একেবারে স্তব্ধ একজন নাগরিক বিশেষ! এ দেশটা, এ অঞ্চলটা, এ অঞ্চলের প্রতিটি ঘরের কষ্টগুলো, ত্যাগগুলো এক হয়েই যে মুক্তির কথাটি আসল তা যেন আমার প্রাপ্তির চেয়ে ঋণের বোঝা বাড়ানোর একটি শব্দ।

স্বাধীন দেশের স্বাধীন গাজীপুরে আজকের কোলাহলে হয়তো সেদিনের কথা মনেই পড়বে না কারো কারো। নির্বাচনের আনন্দে এতদিন ছিল চারদিক খুব আনন্দময়।

বিজয় দিবস আর স্বাধীনতা উদযাপনে এ আনন্দ আমাদের প্রাপ্যই। তবে আসুন না একটু পেছন ফিরে বোধটাকে শান দিয়ে নিই! আজ যারা সামনে থেকে আমাদের নেতৃত্ব দেবেন, তারা একবার সেসব পরিবারের কাছে গিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলি—আমরা তোমাদের ত্যাগেরই সন্তান। তোমাদের ত্যাগে অর্জিত অঞ্চলকে একটি সুগঠিত, সত্য সুন্দর মানুষের অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিতেই এসেছি। প্রতিটি দল, দেশের প্রতিটি মানুষ এভাবে ভাবতে শিখলে দেশে কখনোই সংঘাত আসবে না। যে যেখানে আছে, তার যদি একটাই কামনা থাকে আর সেই কামনা যদি হয় দেশের মঙ্গল—তবে কীভাবে দেশ সংঘাতের দিকে এগোয়! যে দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় শহীদদের রক্ত, সে দেশে কোনো কারণে রক্ত ঝরবে তা যেন কল্পনার বাইরে। সদ্য অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে জনসাধারণ দেশের কল্যাণে কাজ করার যে দায়িত্ব প্রতিনিধিদের কাঁধে তুলে দিয়েছে তা মূলত শহীদদের রক্তের বিনিময়েই প্রতিষ্ঠিত। তাই আসুন, দেশপ্রেমিক শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা গণতান্ত্রিক শুদ্ধতা অর্জনের দিকে এগিয়ে যাই। তবেই হবে সত্যিকারের স্বাধীনতা পাওয়া এক মাতৃভূমি। 

 

লেখক : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads