• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

হাসির পাত্র-পাত্রী

  • মাসুদ কামাল হিন্দোল
  • প্রকাশিত ০৩ জানুয়ারি ২০১৯

হাসির ফজিলতের কথা বলে হয়তো এই আধুনিক কালে শেষ করা যাবে না। আনন্দ এবং হাসি নাকি মানুষের অনেক রোগের ওষুধ। বিষণ্নতা দেহ ও মনের ক্ষতি করে। জ্যাঁ পল সার্ত্রে বলেছেন, ‘ব্যক্তিবিশেষের আনন্দ-হাসি-সচ্ছলতা নিয়ে একটি সমাজ উজ্জ্বল এবং উদ্বেলিত হতে পারে এবং হয়ও।’

গত এক বা দুই দশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে হাসি নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তা থেকে জানা গেছে, হাসি আপনাকে উদার করবে, সামাজিক করে তুলবে, বিষণ্নতা ও মানসিক পীড়ন কমাবে। কর্মস্থলকে ইতিবাচক করে আপনাকে আনন্দ দেবে। হাসির ফলে গলা, পাকস্থলী, মুখমণ্ডল ও স্বরনালির ব্যায়াম হয়। রক্তের চাপ স্থিতিশীল হয় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। এক মিনিট প্রাণখোলা হাসি কয়েক মিনিট গভীর শিথিলায়তনের মতো উপকারী। আর বিশবার হাসি কয়েক মিনিট জগিংয়ের সমান। হাসিতেই অর্ধেক রোগ সেরে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান হাসি থেরাপি সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করে যাচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, প্রাণখোলা হাসির চেয়ে ভালো কোনো ওষুধ মানুষের জন্য নেই। এখন এটা শুধু কথার কথা নয়। বরং যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত বলে বিবেচিত হচ্ছে (সবই শতভাগ পরীক্ষিত নয়)। তবে এসব গবেষণায় কিছু নেতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। হাসতে হাসতে কেউ কেউ না ফেরার দেশেও চলে গেছেন। এমন ঘটনা বিরল নয়। তবে খারাপ বা ক্ষতির চেয়ে লাভের পাল্লাটাই ভারী। ছোটবেলা থেকে এটাই জেনে এসেছি যে— ‘লাফটার ইজ দ্য বেস্ট মেডিসিন।’

এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে আমাদের কী করা উচিত? হো... হো... হে... হে... করে হাসা উচিত। একসময় আমাদের দেশে প্রাণখোলা হাসি নিষিদ্ধ ছিল। বলা হতো যত হাসি তত কান্না বলে গেছেন রাম শর্মা। তাই এদেশের মানুষ বেশি হাসে না বা হাসতে পারে না কান্নার ভয়ে। তারা চেপে বা মেপে হাসে। এমনকি অট্টহাসিও চেপে রাখে। হাসলে নাকি পারসোনালিটি থাকে না। অনেককে দেখেছি পারসোনালিটি রক্ষার জন্য রোবোটিক আচরণ করতে। হাসিকে বিসর্জন দিতে। আমাদের দেশে সংস্কার রয়েছে। গুরুজনরা বলেছেন মেয়েদের বেশি হাসি ভালো নয়। পরে কাঁদতে হবে।

সত্যি সত্যি মেয়েদের হাসির পর কাঁদতে হয় কি-না জানি না। তবে অট্টহাসি হাসলে আমরা অনেকে কেঁদে ফেলি। এ কান্নার ভেতরেও লুকিয়ে থাকে হাসি। কখনো তা হয় আনন্দের কান্না। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ মনে করেন, ‘হাসি সবসময় সুখের কারণ বোঝায় না, মাঝে মাঝে এটাও বোঝায় যে আপনি কতটা বেদনা লুকাতে পারেন।’

প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব হাসি দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব হাসি দিবস পালিত হয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অসংখ্য হাসির ক্লাব রয়েছে। বর্তমানে ভারতে প্রায় ১৬ হাজার লাফিং বা হাসির ক্লাব রয়েছে। ১৯৯৫ সালে সমুদ্রসৈকতে একটি হাসির ক্লাবের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ ধারণার। বেঙ্গালুরুর কিছু অফিসে আছে কর্মীদের অবসাদ কাটানোর জন্য অফিসে হাসির রুমের ব্যবস্থাও। এমনকি নারীদের জন্য আলাদা হাসির ক্লাব। বেঙ্গালুরুর একটি স্কুলে শিশুদের পাঠ্যসূচিতেও যুক্ত হয়েছে একটি নতুন বিষয় হাসি। অন্যান্য বিষয়ের মতো হাসিরও ক্লাস হয় তাদের। তারা নিয়মিত হাসি চর্চা ও হাসি নিয়ে গবেষণা করেন। ভারতজুড়ে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাসির ক্লাব। অবশ্য আমাদের দেশে হাসাহাসি করাটাও বেশ রিস্ক। পাছে লোকে কিছু বলে এ ভয়টা সমসময় রয়েছে। হাসি নিয়ন্ত্রণ কখনো শুভ বার্তা বয়ে আনতে পারে না। স্কুল-কলেজে হাসাহাসি করার জন্য বেত্রাঘাত বা গালমন্দ শোনার ঘটনা অহরহ ঘটে। তারপরও এদেশের মানুষ হাসে এবং হাসায়।

চল্লিশ বছর ধরে আমাদের নিরলসভাবে হাসিয়ে যাচ্ছেন উন্মাদ সম্পাদক কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক আহসান হাবীব। বিখ্যাত স্প্যানিশ দার্শনিক নিকোলাস চ্যাপফোর্টের মতো তিনিও মনে করেন, ‘যে দিনটি হাসা গেল না সেই দিনটি নিদারুণভাবেই ব্যর্থ।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশটা সমস্যাসঙ্কুল একটি দেশ। এই দেশে সবসময় ভালো মুডে থাকা সত্যিই কষ্টকর একটি ব্যাপার। এর জন্য সহজ ট্রিটমেন্ট হচ্ছে জোকস... জোকস... এবং জোকস। জোকস নিজে পড়ুন, নিজে হাসুন, অন্যের সঙ্গেও হাসিটা শেয়ার করুন। কারণ হাসি হচ্ছে এমন এক মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি যাতে আপনি আক্রান্ত হলেও কোনো সমস্যা নেই। চিকিৎসা খরচও নেই।’

আজকাল আমাদের দেশে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান নাচ ও আবৃত্তির পাশাপাশি স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানরাও পারফর্ম করছেন। অর্থাৎ যারা কৌতুক বলে লোক হাসায়। মঞ্চে নাটক দেখার মতো মানুষ এখন টিকিট করে উত্তরা নাভিদ’স কমেডি ক্লাবে যাচ্ছেন। প্রাণ খুলে হাসবেন বলে। ভারতে স্ট্যান্ডআপ কমেডি করে কপিল শর্মাসহ অনেকেই কোটি কোটি টাকা আয় করছেন। এদেরও রয়েছে অন্যান্য শিল্পীর মতো তারকাখ্যাতি, সম্মান ও মর্যাদা এবং একই সঙ্গে অর্থ-বিত্ত-বৈভব-জৌলুস।

আমাদের অতীত ইতিহাসও কিন্তু হাসির কথা বলে। এ অঞ্চলে ঘরে ঘরে হাসির পাত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন গোপাল ভাঁড়। আরো আছেন নাসিরউদ্দিন হোজ্জা, বীরবল। রাজা-বাদশাহ-জমিদাররাও হাসির সমঝদার ছিলেন। সৈয়দ মুজতবা আলীও ছিলেন আমাদের আরেক হাসির রাজা। হাসি ছাড়া আসরও জমে ওঠে না। সুতরাং দিবস ধরে না হেসে আমরা বছরজুড়েই হাসতে চাই।

সুন্দরের জয় সর্বত্র। হাসির জয় সর্বত্র না হলেও হাসি দিয়ে অনেক কিছু জয় করা যায়। হাসতে পারাটাও এখন বড় ধরনের ক্রেডিট আমাদের এই হিপোক্রেসির যুগে। ক’জন হাসতে পারে প্রাণখুলে? তাই ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক একটু হাসুন, এই সমাজটাকে সুষ্ঠু সুন্দর করার জন্য। আমাদের সবার এই কামনা করা উচিত, দেশের সব নাগরিক যেন হাসিতে হাসিতে আশিতে পৌঁছাতে পারেন। প্রতিদিন কাজের চাপ ও ধকল কাটিয়ে উঠতে হাসির কোনো বিকল্প নেই। হাসিখুশি ও আশাবাদী মানুষের সঙ্গে বেশি বেশি মিশুন, আপনার জীবন সুন্দর হাসিময় হয়ে উঠবে। হাসির কন্ট্রোল প্যানেলটা নিজের নিয়ন্ত্রণেই রাখুন। তবে খেয়াল রাখতে ভুলবেন না, আপনার হাসির বিষয়বস্তু বলে দেবে আপনি কেমন ধরনের মানুষ।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রম্যলেখক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads