• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বিরল সততার স্বাক্ষর রেখে গেলেন

সৈয়দ আশরাফ

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

বিরল সততার স্বাক্ষর রেখে গেলেন

  • অমিত বণিক
  • প্রকাশিত ০৯ জানুয়ারি ২০১৯

কিশোরগঞ্জের আলোকিত সেই মানুষ সৈয়দ আশরাফ হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলেন। তার আকস্মিক বিদায়ের সংবাদটি বিশ্বাস করতেই যেন কষ্ট হচ্ছে কিশোরগঞ্জবাসীর। যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে এলাকার মানুষ। দলীয় নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই আক্ষেপ করছে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জন্য। তিনি অসুস্থ ছিলেন তবে আর সেরে উঠবেন না, চলেই যাবেন- ভাবতে পারেননি কেউ। বিরল সততা ও মেধার অধিকারী এই নেতার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।

গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তার মৃত্যুতে গভীর শোকাহত। শোকসন্তপ্ত পরিবার, স্বজনদের জানাই গভীর সমবেদনা। তিনি ফুসফুসে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে গত কয়েক মাস ধরে সেখানে চিকিৎসারত ছিলেন। রাজনীতিতে নির্মোহ, সজ্জন ও পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে উঠে আসা এই রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রেখেছিলেন। কর্মবীর সৈয়দ আশরাফের ৬৭ বছর বয়সে জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটল। তিনি চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত হন। তাকে ঘিরে প্রাণচঞ্চল থাকত পুরো কিশোরগঞ্জ। ঘুরেফিরেই তার কথা উঠত আড্ডায়, আলোচনায়।

সৈয়দ আশরাফ ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক একজন মানুয। একজন জাজ্বল্যমান নক্ষত্র ছিলেন তিনি। সৈয়দ আশরাফের কর্মস্থল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে থাকার সময়ে একটা ঘটনা তুলে ধরছি— ২০১৬ সালে যেটা অনেক পত্রিকায়ও এসেছিল। সে সময় সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় ৭৩ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দেয়। এর মধ্যে ২১ জনকে গোয়েন্দা ক্লিয়ারেন্স নেই- এই অভিযোগে প্রমোশনবঞ্চিত রাখা হয়। সোজা কথা, সরকার যাদের মনে করেছে আনুগত্য নেই, ‘হার্ডকোর আওয়ামী লীগার’ নয়, তাদের প্রমোশন আটকে দেওয়া হয়েছিল। দেশে ফিরে এই অনিয়মের কথা শুনে সবার প্রমোশনে সাইন করা থেকে বিরত থাকেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি জানতে পারেন প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নির্দেশে, এসএসবি সুপিরিয়র কমিটি এটা করেছে। তার পরেও, সৈয়দ আশরাফ নিজের আপত্তি দিয়ে বলেন, প্রমোশনের ক্ষেত্রে একটা পরিষ্কার সার্ভিস রুল তিনি তার মন্ত্রণালয়ে চালু করবেন এবং কোনো অনিয়ম ও পক্ষপাতিত্ব তিনি বরদাশত করবেন না। এরপর বাদ পড়া এবং অনিয়মের শিকার সবাই প্রমোশন পান, সৈয়দ আশরাফের সততার কল্যাণেই।

এই নিউজটা সে সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছিল। তখন অনেকেই খুনসুটি করে তাকে বলতেন বেশি ভালো ভালো নয়। কিন্তু সৈয়দ আশরাফ দেখিয়ে গেছেন ভালো সে তো ভালোই। সকল ভালোই শুভ্র আলো ছড়াতে জানে। স্ত্রীর দুরারোগ্য ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য বনানীর বাড়িটিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন তিনি, তবু সরকারি কোনো সহযোগিতা গ্রহণ করেননি।

আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে গিয়েও তিনি বিরল সততার স্বাক্ষর রাখেন। ছাত্রজীবনেই সৈয়দ আশরাফের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ছাত্রজীবনে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতক খুনি মোশতাক-ফারুক-রশিদ চক্রের হাতে নিহত জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের শিল্পমন্ত্রী, পরে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফ অনেক গুরুদায়িত্বই পালন করে গেছেন। ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানেও তিনি নানা রকম রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হন এবং ওই সরকারের মন্ত্রিসভায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে তিনি ওই দুই মেয়াদেই সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে পান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পালন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। আওয়ামী লীগের ত্যাগী এই নেতা আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন অবিচল। তার মৃত্যুতে পুরো দেশ একজন দেশপ্রেমী রাজনীতিককে হারাল। তার শূন্যতা দেশের রাজনীতিতে অনুভূত হবেই।

 

লেখক : নিবন্ধকার

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads