• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে নগর

  • শাফিউল কায়েস
  • প্রকাশিত ১১ জানুয়ারি ২০১৯

সাম্প্রতিককালে ক্ষিপ্রগতির নগরায়ণের ফলে বায়ুদূষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ধামরাই, সাভার, টঙ্গী, যাত্রাবাড়ী, লালবাগ ও হাজারীবাগে শিল্প-কারখানার কারণে মাত্রাতিরিক্ত হারে বায়ুদূষণ হচ্ছে। ভয়াবহ বায়ুদূষণের শীর্ষে রয়েছে ইটভাটা। মোট দূষণের প্রায় ৫৮ শতাংশ হয় এই ব্যবসার কারণে। ১৫ শতাংশ দূষণ হয় ধুলাবালি থেকে, ১০ শতাংশ যানবাহনের ধোঁয়া থেকে, ৭ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে, অন্যান্য কারণে ৯ শতাংশ বায়ু দূষিত।

শিল্প, আবর্জনা, ইটের ভাটা, যানবাহন, জনসংখ্যার দ্রুত  বৃদ্ধি এবং নগরায়ণ বায়ুদূষণের কয়েকটি প্রধান কারণ। তাছাড়া চামড়াশিল্প, রাসায়নিক গবেষণাগার, পয়ঃশোধনাগার থেকে উৎপন্ন হাইড্রোজেন সালফাইড সবকিছুই জীবজগতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বর্জ্য-আবর্জনা পোড়ানো, ধূমপান ও তামাক সেবনের ফলে উৎপন্ন ধোঁয়া বাতাসে মিশে যাওয়ার ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে প্রতিদিনই বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ  সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থা ইপিএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে প্রথম স্থানে রয়েছে নেপাল। গত বছর ইপিএ’র প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৭৯তম স্থানে নেমে এসেছে। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম ওই সূচকটি তৈরি করা হয়েছিল। সে বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৫তম। গত একযুগে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৫৪ ধাপ নিচে নেমেছে। অন্যদিকে নির্মল বায়ুর দেশ হিসেবে প্রথমে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। পর্যায়ক্রমে রয়েছে বার্বাডোজ, জর্ডান, কানাডা ও ডেনমার্ক।

জাতীয়ভাবে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদফতরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পে দেশের আটটি শহরের বায়ুর মান প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করা হয়। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, গাজীপুর, বরিশাল ও খুলনা শহরের বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ,  যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর ঢাকা। বিশেষত নগর এলাকাগুলো বায়ুদূষণের কারণে দিন দিন মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসারে বায়ুর মানমাত্রার সূচক ১০০-এর উপরে উঠলে তা মারাত্মক ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। বায়ুর মধ্যে ক্ষুদ্র বস্তুকণা এবং চার ধরনের গ্যাসীয় পদার্থ পরিমাপ করে এই সূচকের প্রকাশ। পরিবেশ আইন অনুযায়ী, বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা ্তু পিএম ২.৫্থ এর মানমাত্রা হচ্ছে প্রতি কিউবিক মিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। ্তুপিএম ১০্থ বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার মানমাত্রা ৫০ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকায় এর পরিমাণ প্রায় ৩০০ মাইক্রোগ্রাম।

বায়ুদূষণের ফলে শুধু যে মানুষ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়, অকাতরে জীবনও হারাচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে যেসব রোগের কারণে মানুষের অকালে প্রাণ ঝরে যাচ্ছে- শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী রোগ, ফুসফুস ক্যানসার, হূদরোগ, হাঁপানি, অ্যালার্জি ও স্ট্রোক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, বিশ্বের ৯২ শতাংশ মানুষ বিষাক্ত বায়ু গ্রহণ করে। এর ফলে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪২ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। আমাদের দেশে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট জরিপ কিংবা পরিসংখ্যান নেই। তবে গবেষক, চিকিৎসক, পর্যবেক্ষকদের মতে, বহু রোগ ও মৃত্যুর কারণ হিসেবে রয়েছে দেশের ভয়াবহ বায়ুদূষণ। চিকিৎসক, গবেষক ও পরিবেশবিদরা ভয়াবহ বায়ুদূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যহানি, বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া, মৃত্যুর পরিসংখ্যান কতটা ভয়াবহ, তা নিয়ে একটা প্রতিবেদন ত্বরিত প্রয়োজন।

এসব রোগ থেকে আমাদের মুক্তি পাওয়ার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি অতিরিক্ত ব্যবহারে সচেতন হতে হবে, কালো ধোঁয়া উৎপাদন কমাতে হবে, বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে অর্থাৎ বৃক্ষনিধন বন্ধ করে সারা দেশে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণে পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা ও মলমূত্র ত্যাগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে, ধূমপান ও তামাক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। নির্মাণকাজে যাতে ধুলাবালি সৃষ্টি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

বায়ুদূষণ হ্রাস ও প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানান আইন ও বিধি তৈরির পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে। তবে আমাদের সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের বিশেষ প্রয়োজন। বিভিন্ন ধরনের অসচেতনতা ও অনিয়মের ফলে পরিবেশ আজ নানামুখী বিপর্যয়ের শিকার। নিজেদের স্বার্থেই এই ভয়ংকর বিপদ মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে বায়ুদূষণ হবে আমাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ। পরিবেশ রক্ষায় শুধু সরকার বা পরিবেশ সংগঠনই নয়, নাগরিক অর্থাৎ আমাদের সচেতন হতে হবে।

 

লেখক :  শিক্ষার্থী

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও  প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads