• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

শিক্ষাকে ধ্বংস করছে গাইড ব্যবসা

  • মোমিন মেহেদী
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০১৯

বিনামূল্যে বই দেওয়ার মধ্য দিয়ে বই উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতে দেশের বিভিন্ন বই বিতানে শুরু হয়েছে নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের রমরমা বাণিজ্য। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন বই বিতান ও লাইব্রেরিতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। তবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসচেতন নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, প্রশাসনের নজরধারী ও মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় অসাধু বই ব্যবসায়ীরা সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে প্রশাসনের নাকের ডগায় গাইড বই বিক্রি করছে। আর এই গাইড বই বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, সরকারি বই বিতরণের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে আসছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এই ব্যবসার সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিতানগুলোতে দ্বিতীয় শ্রেণির অনুপম, লেকচার গাইড বই বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়, এই দুই প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় শ্রেণির গাইড বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকায়। আবার চতুর্থ শ্রেণির অনুপম, লেকচার ও পাঞ্জেরি গাইড বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকায়। পঞ্চম শ্রেণির লেকচার, অনুপম ও পাঞ্জেরি গাইড বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ থেকে ৫৫০ টাকায়। ষষ্ঠ শ্রেণির অনুপম, লেকচার ও পাঞ্জেরি গাইড বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ থেকে ৬২০ টাকায়। সপ্তম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণির লেকচার, অনুপম ও পাঞ্জেরি বই বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ থেকে ৮৫০ টাকায়। এভাবে সারা দেশে অবাধে নিষিদ্ধ গাইড বই বিক্রির কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভুক্তভোগী সচেতন নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার মান উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নিরন্তর রাজপথে থাকা জাতীয় শিক্ষাধারার মতো করে রাজপথকে শুধু রাজনীতির সূতিকাগার না করে শিক্ষা-সমাজ-সংস্কৃতি ও সভ্যতার জন্যও নিরন্তর এগিয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন বই বিতানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে এই গাইড ব্যবসায়ীদের প্রতিহত করতে হবে। যদিও প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, গাইড বই বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর কোনো শিক্ষক এর সঙ্গে জড়িত থাকলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু তাদের এসব কথা কেবল দৈনিকের পাতায় প্রকাশিত সংবাদ আর বক্তব্য, বিবৃতি পর্যন্তই। অপরপক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে বিচিত্র নামধারী শতাধিক প্রতিষ্ঠান। আর নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার কারণে এসব প্রতিষ্ঠান লোভের সর্বোচ্চ সীমায় চলে গেছে। এর ফলে দেখা যাচ্ছে স্টেশনারি ও বইয়ের দোকানগুলোতে নিষিদ্ধ গাইড ও নোটবইয়ের ছড়াছড়ি। আইনানুযায়ী গাইড বই বাজারজাত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও কমিশনে বিক্রি করা হচ্ছে গাইড ও নোটবই। অন্যদিকে নামিদামি স্কুল ও কলেজগুলোতে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উপঢৌকন দিয়ে গাইড ও নোটবই তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। অবশ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনেক আগেই নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করেছে। জাতির কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও এ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা দেশে দেদার বিক্রি বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

বিভিন্ন সংবাদে জানা গেছে, পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের কিছু অসাধু প্রকাশনা সংস্থার মাধ্যমে এসব বই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। পৌঁছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে। এ অবস্থা বহু বছর ধরে চলে এলেও বন্ধ করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নোট ও গাইড বইনির্ভর হয়ে পড়েছে। এতে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা আর লাভবান হচ্ছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষক ও অসাধু ব্যবসায়ী। এই অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না কেন- সেটাই একটা প্রশ্ন। নোট-গাইডের ব্যবসা বন্ধে নজরদারি করার কথা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নোট-গাইডের ব্যবসা কীভাবে চলছে তার খোঁজ কি রাখে এনসিটিবি? বাংলাবাজার থেকে এসব বই যাতে উৎপাদন ও বাজারজাত হতে না পারে, এর ব্যবস্থাও কেন নেওয়া হয় না।

সারা দেশে শিক্ষা ধ্বংসের সব ষড়যন্ত্র যখন নির্মমতায় অগ্রসর হচ্ছে, তখন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিকে এগিয়ে আসতে হবে, গণমাধ্যম-প্রশাসনকেও রাখতে হবে যথাসাধ্য ভূমিকা। যে ভূমিকার হাত ধরে এগিয়ে আসবে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্র বলছে, নোট-গাইডের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা বোর্ডের বই পড়ছেই না। অথচ বিভিন্ন স্কুলের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় শিক্ষকরা গাইড বইয়ের অনুশীলনীর প্রশ্ন পরীক্ষার প্রশ্ন হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ কারণে শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যার দিকে ঝুঁকছে। কেননা গাইড বইয়ের ওই উত্তরটি মুখস্থ করলেই পরীক্ষায় পাস করা যাবে। ফলে নোট-গাইডের ওপর নির্ভরশীল থেকে পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ইতিহাস বলছে, নোটবই প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে ১৯৮০ সালে একটি আইন করা হয়। কিন্তু সেই আইন যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নোটবই ছাপানো বন্ধের উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রণালয় ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর সরকারের অননুমোদিত নিম্নমানের বই, নোট ও গাইড বই বাজারজাত বন্ধ করতে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের সাহায্য নিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়। অথচ ২০১৯ সালে এসেও বাজারে দ্বিতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জন্য বিভিন্ন নামে বিভিন্ন কোম্পানির গাইড ও নোটবই পাওয়া যাচ্ছে এটা জাতির জন্য একটি হতাশাজনক খবর। এর পরিত্রাণ হবে কবে।

 

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় শিক্ষাধারা ও চেয়ারম্যান

নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads