• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

গ্রাম হবে শহর

  • শামসুদ্দোহা চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

একাদশ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের এক অন্যতম ইশতেহার ছিল গ্রামগুলো শহরে রূপান্তর করা হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক দলেরই তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে জাতির প্রতি অঙ্গীকার থাকে। সেই উদ্দেশ্যে প্রতিটি দলই তাদের দলীয় ভাবাদর্শের আলোকে নির্বাচনের ইশতেহারে সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করে থাকে এবং প্রত্যেক দলেরই উদ্দেশ্য থাকে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে তাদের ইশতেহারে। সব দলেরই ইচ্ছা থাকে তাদের দলের সেরা অংশটি যাতে ইশতেহারে প্রতিফলিত হয়। জনগণের কাছে ইশতেহারের মাধ্যমে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্তির আশায় দলগুলো তাদের দলের ইশতেহারে প্রচার এবং প্রকাশ করতে উদগ্রীব থাকে। ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশ্য থাকে তাদের অতীতের ভুলত্রুটি সংশোধন করে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন দিনের স্বপ্ন দেখানো। ইশতেহারে দিনবদলের নতুন দিনের চমৎকার স্লোগান থাকে, তরুণদের আকৃষ্ট করার অনেক চমকপ্রদ ঘোষণা আসে, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্যে যা কিছু প্রয়োজন দলগুলো তাদের স্ব স্ব চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটায় তাদের প্রকাশিত ইশতেহারের মাধ্যমে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রকাশিত ইশতেহারের প্রধান একটি অঙ্গীকারও তাই গ্রাম হবে শহর। এখন তারা নির্বাচিত এবং সরকারও গঠন করেছে। আমরা মনে করি, এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের অন্যতম দলীয় স্লোগান হচ্ছে ‘গ্রাম হবে শহর’। সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় উন্নয়নের রোডম্যাপে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় ইশতেহারের এই স্লোগানটি বাংলাদেশের অবহেলিত গ্রামবাসীর কাছে ভালো লাগবে নিঃসন্দেহে।

কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তরের বা পরিবর্তনের রূপরেখাটি কেমন হবে বা কেমন পরিকল্পনায় গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তরের ধারার অবকাঠামোটি গড়ে তোলা হবে? আধুনিক নগর জীবনের মৌলিক সুবিধাদি পাওয়ার বা ভোগ করার অধিকার বাংলাদেশের সব নাগরিকেরই আছে। রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব এবং কর্তব্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তার রোডম্যাপটির সঠিক বাস্তবায়নও একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য। স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোতে বিগত সরকারগুলোর আমলে গ্রামগুলোর যে উন্নয়ন হয়নি তা বলা যাবে না তা কিন্তু নয়। এ কথা স্বীকার্য, গ্রামগুলোকে যখন থানা থেকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়, মূলত সে সময় থেকেই গ্রামের নড়বড়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো দ্রুত সামনে আসতে থাকে। পরিণামে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়, গ্রামগুলোর প্রশাসনিক কেন্দ্র হয় উপজেলা, উপজেলার নিয়ন্ত্রণ কর্তা হিসেবে জেলা শহরের কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পায়। আধুনিক টেলিকমিউনিকেশন, ব্যাংকিং, গ্রাম স্বাস্থ্য কমিউনিটি, প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাস্তাঘাটের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের দ্বার উন্মোচিত হয়। উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে ঝরেপড়া ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। দুস্থ, বিধবা, বিকলাঙ্গ মানুষকে ভাতা প্রদানের ফলে দরিদ্র অবহেলিত মানুষের রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোগ করার পথ প্রশস্ত হয়েছে। মূলত বৃহৎ অর্থে বাংলাদেশ একটি গ্রাম। গ্রামীণ কৃষি অর্থনৈতিক অবকাঠামোই বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। গ্রাম বাঁচলে শহর বাঁচবে। গ্রামীণ উন্নয়ন অবকাঠামো পরিবর্তনে সব সরকারই কিছু না কিছু কাজ করেছে। যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, উপজেলার সঙ্গে গ্রামগুলোর সংযোগ স্থাপিত হয়েছে, উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের সংযোগ সড়ক হয়েছে— এ সবকিছুই হয়েছে সরকারের গ্রামের দিকে দৃষ্টি প্রসারের ফলে। সরকারের এই উন্নয়ন দৃশ্যমান। সরকারের এই উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি পরিবর্তনে খেটেখাওয়া মানুষেরও বিশাল ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে বিগত শতাব্দীতে আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারের দ্বার খুলে যাওয়ার পর গ্রামের মানুষের বিদেশে শ্রম বিক্রির কষ্টার্জিত অর্থ দেশে প্রেরণের মাধ্যমে দেশ তথা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। গ্রামের শনের, টিনের বাসভবন পরিবর্তন হয়ে পাকা দালানকোঠা উঠেছে। মানসিকতার উন্নয়ন ঘটেছে। গ্রামের সাহসী মানুষ নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে নিজেরাই সচেষ্ট হয়েছে।

কথায় আছে, নগর গড়েছে মানুষ, প্রকৃতি, গ্রাম সৃষ্টি করেছে ঈশ্বর। শহর ও গ্রাম এক বৃন্তে দুটি ফুল। একে অন্যের সমার্থক। এ কথা ভুললে চলবে না যে, গ্রাম ও শহরের ভৌগোলিক আদর্শগত কিছু দিক দৃশ্যমান। রবীন্দ্রনাথের কথায় ফিরতে হয়- ‘অবারিত মাঠ গগন ললাট চুম্বে তব পদধূলি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি’- এই গ্রামের সুমহান এক ঐতিহ্য আছে। গ্রাম হবে শহর মানে এই নয়, গ্রামগুলো পরিবর্তন হবে এক কংক্রিটের জঙ্গলে। গ্রামের উদাহরণই হচ্ছে তরুবীথি, সবুজ শ্যামলিমায় ঢাকা, আঁকাবাঁকা খালবিল, ইতলবিতল পথ, নদীনালায় ঘেরা এক সুসজ্জিত নান্দনিক নিসর্গে ভরা প্রকৃতির উদ্যান। গ্রামের ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশকে অক্ষুণ্ন রেখে নাগরিক অধিকার, অবকাঠামো নিশ্চিত করে গ্রামকে আধুনিকায়ন করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। প্রতিটি গ্রামই গড়ে উঠেছিল একটি সুচিন্তিত নির্দিষ্ট পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে। গ্রামের পরিকল্পিত স্থানে সৃষ্টি হয়েছিল হাটবাজার, মেলাপ্রাঙ্গণ, টোল, বিদ্যালয়, ধর্মীয় উপাসনালয়, গোরস্থান, দিঘি, পুকুর, পয়ঃনিষ্কাশনের জন্যে গ্রামের পেছনে খাল। এই খালগুলোর সংযোগ ছিল নদনদীর সঙ্গে যা যোগাযোগ ব্যবস্থা, বন্যার পানি নিষ্কাশনে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছিল। বর্তমানে ভূমিদস্যুদের নখরাঘাতে সেই চিরায়ত ঐতিহ্যবাহী খালগুলোর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এর প্রতিটি ইঞ্চি ভূমিই মূল্যবান। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট ভূমিধসের একটি মূল কারণ। এই অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট নির্মাণে বন্যার পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যার ফলে শস্যহানি ঘটে। পরিকল্পনামাফিক একটি মূল রাস্তা উপজেলার সঙ্গে সংযোগ এবং পানি যাতে না আটকে থাকে, সে জন্যে খালের প্রবহমান বা সংযোগস্থানে কালভার্ট নির্মাণ করে প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করা যেতে পারে। বর্তমান সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। অপরিকল্পিতভাবে কলকারখানা নির্মাণের ফলে কলকারখানার বর্জ্যে সয়লাব হচ্ছে নদনদীর পানি। ইদানীং এই বর্জ্য শহরের নদনদীকে দূষিত তো করছেই, এর রেশ পড়ছে গ্রামের নদনদীগুলোতেও। যার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জনজীবনের স্বাস্থ্যও চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। মনে রাখতে হবে নদী শেষ হলে সভ্যতাও শেষ হয়। নদনদীগুলো হলো একটি দেশের ফুসফুস। এই নদনদীগুলো মিঠাপানি এবং মাছের জোগান দিয়ে আসছে বাঙালিকে আবহমান কাল ধরে। দেশি সুস্বাদু মাছ এই দূষিত বর্জ্যের ফলে দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ কথা ভুললে চলবে না মিঠাপানির মাছ গ্রামীণ মানুষের অন্যতম আয়ের উৎস। উন্নত বিশ্বে জন-অধ্যুষিত এলাকা থেকে বহু দূরে কলকারখানার জন্যে আলাদা জোন সৃষ্টি করা হয়। সুতরাং যে কোনো মূল্যে নদনদীর পানি রক্ষা এবং খননের মাধ্যমে নদনদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

আমাদের শিকড়ের উৎস গ্রাম। গ্রামের লোকজ সংস্কৃতি, কৃষ্টি, লোকাচার বাঙালির আবহমান কালের সম্পদ। আউল বাউল মরমি কবিদের তীর্থস্থান গ্রাম। গ্রামের লোকজ সংস্কৃতি বাঙালির পরাণের গহিনের সম্পদ। কোনোক্রমেই লোকজ সংস্কৃতি বিনষ্ট করা বা হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। তদুপরি প্রতিটি গ্রামের ভেতরেই লুকিয়ে আছে একাত্তরের না জানা ইতিহাস। সে ইতিহাসকে উদ্ধার করে গ্রন্থিত করতে হবে এবং স্ব-স্ব গ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে কোমলমতি কিশোর-কিশোরীদের সামনে তা উপস্থাপন করতে হবে। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কৃষিজমিগুলো হয়ে যাচ্ছে এক একটি নতুন গ্রাম। ভবিষ্যতে কৃষিজমি বা ফসলি জমিগুলো যাতে ধ্বংস না হয়, সে জন্যে বহুতল ফ্ল্যাট নির্মাণ এবং তা কিস্তিতে বিক্রি করে কৃষিজমি রক্ষা করা যেতে পারে। ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, যেখানে হাতে-কলমে (কাঠমিস্ত্রি, ইলেকট্রিশিয়ান, হাঁস-মুরগি ও গাভি পালন) প্রশিক্ষণ দিয়ে বেকার তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা কোনো কঠিন কাজ নয়। গ্রামের শাকসবজি, মাছ সংরক্ষণের জন্যে হিমাগার, ছোট ডেইরি ও পোল্ট্রি ফার্ম, শিশুপার্ক, ক্রীড়াঙ্গনের জন্যে মাঠ, পাঠাগার, সংস্কৃতিচর্চার জন্যে উন্মুক্ত অডিটোরিয়াম, কমিউনিটি ক্লিনিক, গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হতে পারে— এমন উন্মুক্ত স্থান, রাস্তা এবং নদ নদী খালবিলের দু’ধারে তরুলতা শোভিত বৃক্ষ এবং দেশি ফলের বৃক্ষ রোপণ, হারিয়ে যাওয়া খালগুলোকে পুনরুদ্ধার, খনন, উপাসনালয়, কবরস্থান, দিঘি-পুকুর সংরক্ষণ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পঠন, আরো বিবিধ বিষয় পর্যালোচনা করে একটি গ্রামকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উপ-শহরে পরিণত করা যেতে পারে। কেবল তা হলেই গ্রামের সুমহান ঐতিহ্য ঠিক থাকবে, যা কোনোক্রমেই অসম্ভব নয়।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads