• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমে যাচ্ছে

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

ক’বছর আগেও মানিকগঞ্জের একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষার্থীসংখ্যা ছিল ৩০০। আজ সেখানে মাত্র ২২ শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাত্র একজন শিক্ষার্থী। বিদ্যালয়টির নাম নিমতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে, ২০১৩ সালে জাতীয়করণ করা হয়। শিক্ষকসংখ্যা প্রধান শিক্ষকসহ চারজন। এই চিত্র শুধু মানিকগঞ্জের নিমতা স্কুলের নয়, কমবেশি দেশের সর্বত্র। সংবাদটি দেখলাম একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে। আর একটি বাংলা দৈনিকে দেখলাম দেশের ৫ হাজার ৩৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা ১০০। ৭ হাজার ৭৬৪টি বিদ্যালয়ে রয়েছে ৩ শিক্ষক। ৭২১টিতে ২ জন এবং ৭৯টিতে মাত্র একজন শিক্ষক। এই তথ্য ও ফিগারগুলো সবই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের করুণ অবস্থার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি রয়েছে ইবতেদায়ি মাদরাসা এবং কিন্ডারগার্টেন। সরকারি-বেসরকারি, ইবতেদায়ি ও কিন্ডারগার্টেন সব মিলিয়ে ২০১৩ সালে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ১,০৬,৮৫৯টি এবং শিক্ষার্থী ছিল ১,৯৫,৮৪,৯৭২; ২০১৪ সালে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১,০৮,৫৩৭টি এবং শিক্ষার্থী ছিল ১,৯৫,৫২,৯৭৯ জন; ২০১৫ সালে বিদ্যালয় ছিল ১,২২,১৭৬টি এবং শিক্ষার্থী ছিল ১,৯০,৬৭,৭৬১ জন; ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১,২৬,৬১৫টি এবং শিক্ষার্থী ছিল ১,৮৬,০২,৯৮৮ জন; এবং ২০১৭ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১,৩৩,৯০১টিতে এবং শিক্ষার্থীসংখ্যা ১,৭২,৫১,৩৫০ জনে। এর অর্থ হচ্ছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাও দেশে বেড়েছে এবং শিক্ষার্থী সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা সে হারে বাড়ছে না। মানিকগঞ্জের নিমতা বিদ্যালয়ের চিত্রই তা বলে দিচ্ছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৩ সালে সরকারি রেজিস্টার্ড  বিদ্যালয় ছিল ৭৮টি এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩০০০। তা বেড়ে ২০১৭ সালে হয়েছে ১৪৭টি আর শিক্ষার্থী সংখ্যা ৮০৫১১ জন। যদিও এই সংখ্যা ৩৫০টিরও বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কারণ সবাই সরকারি দফতরে (শিক্ষা বোর্ডে) রেজিস্ট্রি করে না। কওমি মাদরাসার সঠিক হিসাব নেই তবে ১৪০০০-এর উপরে হবে। বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ জনসংখ্যার বয়স ১৫ বছরের নিচে (ডেইলি স্টার, ২০ নভেম্বর ২০১৮) এবং ৪০ মিলিয়ন বিদ্যালয় উপযোগী শিশু রয়েছে।

আমরা জানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলাধুলার মাঠ আছে, বিদ্যালয় ভবন আছে, জাতীয় বেতনপ্রাপ্ত শিক্ষক আছেন, তারপরও ছোট ছোট কিন্ডারগার্টেন কিংবা এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা নিচ্ছে। কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের দেশব্যাপী এক সমীক্ষার ফল এর উত্তর বলে দিচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণি পাস করা প্রতি চারজনের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী লিখতে পারে না, পড়তে পারে না এবং দুই অংকের গণিতের যোগফল পারে না, যদিও দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রস্ততির জন্য মূল শিক্ষা বিদ্যালয় থেকে দূরীভূত হয়েছে। পরীক্ষার মাধ্যমে তারা যে জ্ঞান অর্জন করছে তার সাথে বাস্তব জীবনের জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা নেই।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে খেলার মাঠ আছে কিন্তু খেলাধুলা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর প্রাপ্তি ও উঁচু গ্রেড প্রাপ্তির সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার সময়কে সংক্ষিপ্ত করেছে কিংবা একেবারেই নির্বাসনে পাঠিয়েছে। এই সংস্কৃতি কোচিং সেন্টার কিংবা কিন্ডারগার্টেনে থাকতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালিত বিদ্যালয়ে থাকার কথা নয়। খেলাধুলা শিশুদেরকে কল্পনার জগতে নিয়ে যায়, যার সাথে রয়েছে সৃজনশীলতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। খেলাধুলার জগতে নেই বাস্তব জীবনের টানাপড়েন। খেলাধুলা তাদেরকে বিভিন্নমাত্রিক চিন্তার খোরাক জোগায়, সৃজনশীল পথে পরিচালিত করে। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এসব উধাও হয়েছে।

বাংলাদেশের অনেক জেলায় ৪০ শতাংশের কম শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছে। গরিব পরিবারের ২৭ শতাংশ শিক্ষা বহির্ভূত, সচ্ছল পরিবারের ১৩ শতাংশ শিক্ষা বহির্ভূত। সরকার ৭.৯ মিলিয়ন প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের স্টাইপেন্ড দিয়ে থাকে। ২৭ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই, ৭ শতাংশে সহকারী শিক্ষক নেই। অষ্টম শ্রেণিতে ঝরে পড়া বালিকার হার ৩৭ শতাংশ আর বালকের হার ৫ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে নিম্ন মাধ্যমিকে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বাইরে, যা ৪৬ শতাংশ। এই সংখ্যা সবচেয়ে ভয়ানক শহরের বস্তি এবং দেশের দুর্গম এলাকায়। ৫-১৭ বছর বয়সী সাত মিলিয়ন শিশু রয়েছে শিশুশ্রমে নিয়োজিত।

উপরের সব ফিগারই বলে দিচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। নতুন সরকারকে দেশের শিক্ষার এই ভিতটি অবশ্যই মজবুত করতে হবে যা শুধু কাগজে-কলমে করলে হবে না, বলার মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না। বাস্তবতার নিরিখে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। ২০১৮ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী বলেছেন কিন্ডারগার্টেনগুলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে প্রতিযোগিতায়

টিকবে না।

আমরাও চাই রাষ্ট্র পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা হবে বর্তমান যুগের চাহিদামাফিক এবং মানসম্মত। শিক্ষাবিদ টনি ওয়েগনার বলেছেন,  Students spend their school hours bored, covering irrelevant materials, doing mindless tasks, taking far too many standardized tests, and having the creativity and innovation schooled out of them.’ এই বিষয়গুলো ঘটছে আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যা নতুন সরকারকে দেখতে হবে, ভাবতে হবে এবং সে অনুযায়ী নতুন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ বিশ্বনন্দিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন,‘Education is the most powerful weapon we have at our disposal to change the world.’

 

লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি

masumbillah6 5@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads