• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মতামত

দেশীয় অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাত

  • প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

হা রু ন - আ র - র শি

৭ থেকে ১০ ডিসেম্বর ২০১৮, বহুল প্রচারিত কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ ছিল দেশের ব্যাংকিং খাতে দশ বছরে লোপাট হয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংক মূলধন ভাঙিয়ে পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে। আমানতকারীদের বলে দিয়েছে ২০ হাজার টাকার বেশি চেক দেবেন না। দশটি ব্যাংক তাদের মূলধনও ভেঙেছে। আমানত না আসায় গত দুই বছরে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৭৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ ধার করে গ্রাহকদের ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ১০ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে চারগুণ।

মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০০৯ সালে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর গত সেপ্টেম্বর (২০১৮) শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে চারগুণেরও বেশি। এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যে ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ (ইধফ ফবনঃ) যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক তথ্য। ব্যাংক কর্মকর্তারাই বলেছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ৩০টির বেশি ব্যাংক এখন ধার করে (ঋণ করে) চলছে। দশটি ব্যাংক তাদের মূলধন ভেঙে খাচ্ছে। আরো কয়েকটি  ব্যাংক প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। এমন বিপজ্জনক অবস্থা বিগত ৪৭ বছরে ব্যাংকিং খাতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে আরো জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৮ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা মোট ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৩ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৫৮ ভাগ। বিদেশি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে যা বিতরণ করা ঋণের ৭ ভাগ। বিশেষায়িত দুই ব্যাংক ২৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে, যা বিতরণ করা ঋণের ২১ ভাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত জুন ২০১৮ পর্যন্ত ৮৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। অবশ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ২২ নভেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত আরো কয়েক হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এছাড়া ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা আর ঋণ অবলোপন আছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।

আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দুই বছরে ব্যাংকগুলোর সংগৃহীত আমানতের চেয়ে ৭৭ হাজার ৭৪১ কোটি  টাকা বেশি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই পরিমাণ অর্থ ঋণ বা ধার করেছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দুই বছরে তথা ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ২ লাখ ৪২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা। যদিও এ সময়ে আমানত এসেছে মাত্র ১ লাখ ৬৪ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। অঙ্ক কষলে দেখা যায়, গত দুই বছরে আমানতের তুলনায় ঋণের পরিমাণ ৭৭ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৭৭ হাজার ১২০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আমানত  ছিল ৮ লাখ ৯৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আমানত ছিল ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ১৭ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ বিতরণ করে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ঋণ বিতরণ করেছিল ৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।

ব্যাংকিং খাতের বর্তমান জটিল সমীকরণ দেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে যতদিন সুশাসন আসবে না ততদিন খেলাপি বাড়তেই থাকবে। এক্ষেত্রে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যথাযথ দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনসহ চার দশক ধরে ব্যাংক খাতে গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছেন খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, বিএনপির বড় ব্যর্থতা ছিল সন্ত্রাস দমন করতে না পারা। আর গত দশ বছরে আওয়ামী লীগের বড় ব্যর্থতা ব্যাংক খাতের অরাজকতা বন্ধ করতে না পারা। এসব দূর করতে অর্থমন্ত্রীর তেমন জোরালো উদ্যোগ ছিল না। খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ আরো বলেছেন, সরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণের পুরো ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া সত্ত্বেও তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এদিকে দেশে ১০ বছরে বহু নতুন ব্যাংক গড়ে উঠেছে। এদের অবস্থা আরো খারাপ। দেশের সর্বশেষ ৬০তম তফসিল ব্যাংক হিসেবে ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত হয় বেঙ্গল ব্যাংক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহলের লবিং ও সরকারের চাপে নির্বাচনী মাসে এসে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন দিতে হলো বেঙ্গলকে।

বর্তমানে দেশে ৯টি সরকারি, ৪২টি বেসরকারি এবং ৯টি বিদেশি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে। সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামাল বলেছেন, ব্যাংকিং খাতে সরকারের কিছু ওভার সাইড দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে আর্থিক খাতে সমস্যা হয়েছে। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টিতে বড় কেলেঙ্কারিতে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, এসব কেলেঙ্কারি ঘটেছে মূলত সরকারি ব্যাংকে। এদিকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশের ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সরকারি কোনো ব্যবস্থা সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। বাড়তি খেলাপি ঋণ যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ অনুমোদন, ঋণ বাড়িয়ে নিতে রাজনৈতিক প্রভাব, পরিচালনা পরিষদে রাজনৈতিক পরিচয়, ব্যাংকারদের পেশাদারিত্বের অভাবে মূলত দেশের ব্যাংকিং খাত এখন ক্রান্তিকাল পার করছে। ৮ ডিসেম্বর ২০১৮ রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমাদের করণীয় কী’ শীর্ষক এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এসব কথা তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। ১০ বছরে এত বড় অঙ্কের টাকা লুটপাট হয়েছে— সোনালী, জনতা, বেসিক, এবি, ফারমার্স, প্রাইম, প্রিমিয়াম, এনসিসি, মার্কেন্টাইল, ঢাকা, যমুনা, এনআরবি কমার্শিয়াল, শাহজালাল এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। এই লুট হয়ে যাওয়া টাকা দিয়ে দেশে অনেকগুলো উন্নয়ন কাজের অর্থায়ন করা সম্ভব হতো। জনগণের আমানত রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম রোধে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে সরকারের আলোচনায় বসা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমান  নতুন সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামাল ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অরক্ষিত অর্থ ব্যবস্থাকে সুরক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করে জনস্বার্থে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এবং একই সঙ্গে সচল অর্থনীতির ব্যাপারে আগাম যে প্রতিশ্রুতির বাণী শুনিয়েছেন তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার নীতিগত সিদ্বান্ত গ্রহণ করবেন বলে বিশ্বাস করি। আর এটাই জনগণের একান্ত প্রত্যাশা।

 

লেখক : অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads