• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

মুক্তিযোদ্ধা ও পরোপকারী সাংবাদিক বিদ্যুৎ চৌধুরী

  • গোলাম কাদের
  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বন্ধুবৎসল, হূদয়বান সাংবাদিক এন এ করিম বিদ্যুৎ চৌধুরী দীর্ঘদিন রোগে ভুগে স্বজনকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সংবাদপত্র জগতে এক প্রবাদপুরুষের মতো সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। সবাই জানতেন বিদ্যুৎ চৌধুরী নামে। ছাত্রজীবনের শুরুতেই সমাজের অনাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে বিক্রমপুরের তালতলা পতিতালয় তার নেতৃত্বে ভেঙে দেওয়া হয় এবং ১৯৬৮ সালে সিরাজদিখান থানার অত্যাচারী ওসি চেরাগ আলীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরে ওই ওসি জনসম্মুখে প্রকাশ্যে মাফ চান। তাকে মাফ চাওয়ায় বাধ্য করা হয়। ’৬৯-এর গণআন্দোলনে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি কফিল উদ্দিন চৌধুরী ও সংগ্রামী কৃষক নেতা জিতেন ঘোষের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে তৎকালে পরিচিতি লাভ করেন। ’৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বিদ্যুৎ বাহিনীর গেরিলারা তালতলা, আগলা, গালিমপুর, ঘোড়দৌড়, বক্তাবলীসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকবাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেন। কমান্ডার বিদ্যুৎ চৌধুরী বিক্রমপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ছিলেন।

যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে অস্ত্র রেখে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে সাপ্তাহিক খবর-এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরে জনতার বাণী ও অর্থবাণীতে সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মিরপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকদের একমাত্র আবাসন প্রকল্প মিরপুরে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশিষ্ট সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, সৈয়দ আবদুল কাহারসহ তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। লেপ্রোসি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এবং ফেয়ার অবজারভেশন ফোরামের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তিনি ট্রুথ কমিশন ও সাংবাদিকদের সপ্তম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া সমাজের বহুবিধ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সমাজ উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। বিশেষ করে রোগী, দুস্থ সাংবাদিক, দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা বিদ্যুৎ চৌধুরী সবসময় নিবেদিত ছিলেন।

হূদয়বান এই মুক্তিযোদ্ধা যখন যেখানে থাকতেন, তাকে ঘিরে থাকত অভাবী বেকার দুস্থ সাংবাদিক, দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ও নানান জরা-ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ। সামর্থ্য অনুযায়ী সবাইকে সাহায্য করতেন তিনি। কখনো মহাখালীর কুষ্ঠ হাসপাতাল, কখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ওষুধপথ্য, চিকিৎসাসেবাসহ তার সহানুভূতি পেয়ে অনেকেই সুস্থ জীবন পেয়েছেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা সাংবাদিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সব দায়িত্ব নিতেন। জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে বিদ্যুৎ চৌধুরী পৌঁছলে কোনো কিছুই আর আড়ালে থাকত না। তিনি সাধ্যমতো সবার অভাব-অভিযোগ শুনতেন, সাহায্য করতেন। ঈদ উৎসবে সবাইকে ঈদসামগ্রী বিতরণ করতেন। তিনি প্রতি বছর বিদ্যুৎ চৌধুরী ফাউন্ডেশনের ব্যানারে গরিব পরিবারের ছেলেদের জন্য ক্যাম্প করে তিনশ থেকে পাঁচশ জনের খাতনার ব্যবস্থাসহ চিকিৎসা, নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করতেন। তিনি ছিলেন সমাজের এক উজ্জ্বল দরদী মানুষ।

প্রতিদিন সকালে তার বাসায় দুঃখী মানুষের ঢল নামত। পরম মমতায় তিনি আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শুনে সমাধান দিতেন। পরিবারের লোকজন এ ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তার কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এমন বহু গুণী মানুষ তাকে সমীহ করতেন, উৎসাহ দিতেন। তিনি ছিলেন কর্মবীর। সকাল থেকে রাত অব্দি তিনি সামাজিক কাজের পেছনে ছুটে বেড়াতেন। সমাজে নানা অসঙ্গতির ব্যাপারে সচেতনতামূলক সেমিনার, কর্মশালায় তার  উপস্থিতি ছিল নেতৃত্বের পর্যায়ে।

মিরপুর দশ নম্বরে ডা. আজমল হাসপাতালে তাকে সন্ধ্যার পর নিয়মিত পাওয়া যেত। বিদেশে অবস্থানরত বিক্রমপুরের ডা. আজমল বিদ্যুৎ চৌধুরীর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার হাসপাতাল ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে গিয়েছিলেন। কুষ্ঠরোগীদের নেতা তাহের প্রত্যেক ঈদে ৫০০ কুষ্ঠরোগীর তালিকা নিয়ে তার কাছে হাজির হতেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজন করে সবাইকে ঈদের আগে ঈদসামগ্রী দেওয়া হতো। আমার অত্যন্ত কাছের লোক সাংবাদিক ম. কামাল বিদ্যুৎ চৌধুরীর সব কাজে উৎসাহ দিতেন। মানুষকে সম্মান দেওয়া, বিনয়ী হওয়া, আদপের সঙ্গে চলা, আধ্যাত্মিকভাবে চলা- এগুলোর সঙ্গে একটি মিল সবসময় খুঁজে পেতাম। তাই প্রায় ৩০ বছরের বন্ধুপ্রতিম ভাই স্বজন সহকর্মী বিদ্যুৎ চৌধুরীকে হারিয়ে আমরা যারা সমাজকর্মী, তারা শোকাহত।

অসুস্থতার জন্য তিনি স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন। শেষের দিকে চলৎশক্তি রহিত হয়ে যাওয়ায় প্রিয় মানুষজনকে দেখতে চাইতেন। পাশে থাকতে চেষ্টা করেছেন। তবে মৃত্যুর দিন ময়মনসিংহে থাকায় তার শেষযাত্রায় অংশ নিতে পারিনি। হূদয়বান বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক বিদ্যুৎ চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর ১০ নম্বরের কবরস্থানে দাফন করা হয়। এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাকে সবার পক্ষ থেকে স্যালুট।

বিদ্যুৎ চৌধুরীর বাবা শাহ মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন, মা মরহুমা ফালাতুন নেছা। ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুর তথা আজকের মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার গোড়াপি পাড়া গ্রামে তার জন্ম। বিদ্যুৎ চৌধুরী গোড়াপি পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। মালখা নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, পরে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads