• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা

পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ

ছবি : ইন্টারনেট

মতামত

পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা

  • তাহসিন আহমেদ
  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০২ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় সরকারি সফরে এসে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের মন্তব্য খাতায় লিখেছিলেন, ‘আপনাদের পাকিস্তানি ভাই ও বোনেরা একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য আপনাদের বেদনার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে যে মাত্রাতিরিক্ত ঘটনা ঘটে, তা দুঃখজনক।’ পরে রাষ্ট্রীয় ভোজে ভাষণ দিতে গিয়ে মোশাররফ তার দুঃখের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন, সঙ্গে এ কথাও যোগ করেন যে, ‘এই ট্র্যাজেডি, যা আমাদের দুই দেশের ওপর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, তার জন্য আমরা দুঃখিত।’ মোশাররফের এই দুঃখ প্রকাশকে সে সময় বাংলাদেশের অনেকেই একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা বলেছিলেন। সে সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। সেই রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় মোশাররফের ভাষণের জবাবে খালেদা জিয়া বললেন, ‘একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য এমন খোলামেলা বক্তব্যে আপনাকে ধন্যবাদ। এই বক্তব্য, কোনো সন্দেহ নেই, পুরনো ক্ষত মেটাতে সাহায্য করবে। আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাই এবং ভাইয়ের মতো একযোগে কাজ করতে চাই।’

২০০২ সালে পাকিস্তানের ভেতরেই অনেকে মোশাররফের দুঃখ প্রকাশকে যথেষ্ট নয় বলে তার সমালোচনা করেছিলেন। পাকিস্তানের বেসরকারি মানবাধিকার কমিশন সে সময় পত্রিকার পাতায় পূর্ণ পাতা বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছিল, মোশাররফ দুঃখ প্রকাশ করে ঠিক করেছেন, কিন্তু শুধু দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানের ৫১টি সুশীল সমাজভুক্ত প্রতিষ্ঠান সে সময় এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, একাত্তরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা গণহত্যা। মোশাররফের দুঃখ প্রকাশের ভেতর দিয়ে সেই গণহত্যার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনার অনুভূতি প্রকাশিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। পাকিস্তান এখনো পুরোপুরি ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি। ১০ বছর পর ঢাকায় এসে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি একাত্তরের ঘটনাবলির জন্য কোনো ক্ষমাপ্রার্থনা করেননি। ঢাকায় ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলার সময় সাবেক পাকিস্তানি ক্রিকেটার, বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে সামরিক অভিযানের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত।

পাকিস্তানি সাংবাদিক আকিল খান করাচির ডন পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘সবাই বলছে, সময় এসেছে ক্ষমা করার ও পুরনো ঘটনা ভুলে যাওয়ার। আমাদের ক্ষমা করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে শুধু বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু ভুলে যাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তার জবাবে বলা যায় বাংলাদেশ সে ঘটনা কখনোই ভুলবে না, আর আমাদের (পাকিস্তানিদের) তা কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু বারবার তাদের বিচারের কথা বলেছিলেন। বিচারের জন্যই ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই ঘোষণা করা হয় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩’। এই আইনে স্থানীয় ও পাকিস্তানি উভয় ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সুযোগ ছিল। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ স্বাক্ষরিত চুক্তিতেই বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের ওইসব বন্দি যে মাত্রাতিরিক্ত ও বহুমাত্রিক অপরাধ করেছে, তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনা এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত।

১৯৭৪ সালের ২৮ জুন ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের সময়ও বঙ্গবন্ধু তার হাতে যুদ্ধাপরাধের বেশ কিছু প্রমাণ তুলে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া একাত্তরের ঘটনা তদন্তে পাকিস্তান হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেছিল, তাতেও গণহত্যার প্রমাণ সরবরাহ করেছিল বাংলাদেশ। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসরদের যুদ্ধাপরাধের বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করা হয় এবং কয়েকজন সামরিক কর্তার শাস্তির সুপারিশও ছিল। পাকিস্তান কিছুই করেনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণহত্যার একটি হয়েছিল বাংলাদেশে, সেটি বরাবরই পাকিস্তান আড়াল করে রেখেছে, অস্বীকার করেছে। ১৯৭৪ সালে নয়াদিল্লি চুক্তিতে পাকিস্তান কোনো রকমে নিজেদের বন্দিদের ছাড়িয়ে নিতে ক্ষমা চাইলেও পরে বারবার প্রমাণ করেছে একাত্তরের জন্য তারা অনুতপ্ত নয়।

 

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads